Saturday, December 6, 2025

ভালোবাসা কারে কয়

১২৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগে হৃদ্‌যন্ত্রের আকৃতির চিহ্নটি দিয়ে পাতা বা ফুলের পাপড়ি বোঝানো হতো। প্রেমে পড়ত মানুষের মগজ। কবে যেন সমস্ত কৃতিত্ব হৃদয়ে গিয়ে জমল। তবে হৃদয়ের হোক বা মগজের, ‘কেউ ভালোবাসে’—এর চেয়ে ভয়ানক ও তীব্র আনন্দের অনুভূতি কী হতে পারে! মানুষের চাহিদার যে সূত্র মাজলো আবিষ্কার করেছেন, তাতে ন্যূনতম ও নিরাপত্তা–চাহিদার পরেই আসে ভালোবাসা। ভালোবাসার অবর্তমানে মানুষের বাঁচা কঠিন।

ভালোবাসা অর্থাৎ ‘Love’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘লূভ্যাতি’ থেকে, যার অর্থ গভীর ইচ্ছা। তবে শব্দ নিয়ে কে ভাবে, মানুষ কেবল ভালোবাসাবাসিতে জড়ায়। ওয়াল্ট ডিজনির চরিত্র, পু বেয়ারকে যখন পিগলেট Love শব্দের বানান জিজ্ঞাসা করে, সে জবাব দেয়, ‘ওটা বানান করে না, শুধু অনুভব করে।’ এই অনুভূতির জোর এতটাই প্রকট যে ভালোবাসায় প্রবেশ এবং তা থেকে প্রস্থান করতে করতেই মানুষ পরিণত হয়। ভালোবাসা হারানোর তীব্র কষ্টের স্বাদ পাবার পরেও বারবার মানুষ ভালোবাসার ‘ফাঁদে’ জড়ায়। কারণ, এই ঘোরের আমন্ত্রণ অস্বীকার করার মানসিক শক্তি অর্জনে তাকে বহুবার ভালোবাসার সুখময়তাও খোয়াতে হয়, কিংবা শতবার হারালেও ঘোরটুকু নতুন লাগে।

ভালোবাসা মানুষকে পূর্ণ করে, আবার শূন্যও করে। তাই বলে কি মানুষ ভালোবাসতে ভুলেছে কখনো? পৃথিবীতে যদি প্রতিদিন প্রায় চার লাখ মানুষ জন্মায়, তবে অন্তত তিন লাখ মানুষ প্রথম প্রেমের সাক্ষাতের দিকে পা বাড়ায়। থমাস জের ডিফাইনিং লাভ বইয়ে দেখা যায়, মানুষ জীবনের ৬.৮ শতাংশ সময় ভালোবাসার মানুষের পেছনে ব্যয় করে।

ভালোবাসার আছে নানান রকমফের, দূর থেকে ভালোবাসা, এমনকি কখনো মুখোমুখি না হয়েও ভালোবাসা। এত গুরুত্বপূর্ণ জীবনীশক্তি বলেই হয়তো শিল্পে ও সাহিত্যে ভালোবাসা বহুল ব্যবহৃত ও অপরিহার্য বিষয়। প্রেমকে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাসের চরিত্রের মুখে উচ্চারিত বক্তব্যগুলো ক্রমাগত পাঠকের কানে বাজে। লিও তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস-এ যেমন, ‘আমি যা কিছু বুঝি, যতটুকুই বুঝি, বুঝি কারণ আমি ভালোবাসি।’ অস্কার ওয়াইল্ডের আ ওম্যান অব নো ইম্পর্টেন্স-এ, ‘ভালোবাসায় ডুবে থাকলে মানুষ কখনো দরিদ্র থাকে?’ পাওলো কোয়েলহোর দ্য আলকেমিস্ট-এ, ‘তোমাকে ভালোবাসতেই হবে। কারণ, সমগ্র বিশ্ব তোমার সঙ্গে আমাকে মেলানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।’ ওদিকে, পাবলো নেরুদা জানান ভালোবাসা কত অবশ্যম্ভাবী আর একীভূত হবার সহজ প্রক্রিয়া:

‘কীভাবে, কখন কিংবা কোথা থেকে, না জেনেই তোমাকে ভালোবাসি।

ভালোবাসি, এটাই সহজ সত্য,

জটিলতা ও অহংকারহীন;

ভালোবাসি—কারণ জানি

না বেসে উপায় নেই কোনো।’

কল্পকাহিনি বা কবিতা জীবনের বাস্তব সত্য নয়, কিন্তু একেকটা দৃশ্য বা পঙ্‌ক্তির মধ্য দিয়ে আমরা পৃথিবীর বাস্তবতাকে গ্রহণ ও মোকাবিলা করতে শিখি। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নিবিড় ভালোবাসায় ডুবে থাকা আর এক বিষয়ে মগ্ন থাকার মানসিক বৈকল্য একই রকম ব্যাপার। ভালোবাসার টানে মানুষ পরিবার, শহর, ধর্ম, জীবনের নিশ্চয়তা—কী ছাড়তে না পারে! সামাজিকতার বাইরের ভালোবাসাও আমাদের কাছে আদরণীয়, শিল্পে যা প্রতিষ্ঠিত। তাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝিতে কপিলার আকুতি, ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ কতই না স্বাভাবিক! পাঠকমনেও সেই আকুলতারই জয় হয়।

ভালোবাসার এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি শারীরিক আকর্ষণ। বিতর্ক অবশ্য আছে যে ভালোবাসার লক্ষ্যই কি যৌনতা? যৌনতা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্যই কি ভালোবাসার আবহ রচনা? কিন্তু ভালোবাসাবাসির সাবলীল যৌনতা কি প্রেমেরই অবধারিত ধাপ নয়? বিখ্যাত অনেক লেখকের রচনায় ভালোবাসায় আবদ্ধ জুটির একে অন্যের হাত ধরতেও সংকোচ বোধ করছে—এমনটা আকছার পাওয়া যায়। তবে সামাজিক বাস্তবতা এতটাই বদলে গেছে, এখন ও রকম দৃশ্য আরোপিত মনে হতেই পারে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ প্লেটোনিক ভালোবাসাকে অন্তরে দিয়েছিল ঠাঁই। কিন্তু সেই মানুষই কখনো হয়তো সন্দেহে ভুগেছে, প্লেটো নিজে কি প্লেটোনিক ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিলেন? করোনাজনিত দূরত্বের কালে প্লেটোনিক ভালোবাসার পাল্লা এখন সামান্য ভারী হলেও হতে পারে। তবে এখনকার প্রজন্ম প্রকাশ করে বেশি, গোপনীয়তা তাদের ভূষণ নয়। তাই শারীরিক আকর্ষণ বা সম্পর্ক লুকিয়ে রাখা তাদের কাছে বাহুল্য। প্রেমের চিঠি লিখে জবাবের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করা এদের বাস্তবতা নয়। প্রকাশ দ্রুত বলে তাদের ভালোবাসার ধাপগুলোও দ্রুত।

অনলাইনে যোগাযোগের সুবিধা বহু বছর ধরেই মানুষকে প্রকাশ্যে বা গোপনে যৌনতার স্বাধীনতা দিয়েছে। তাই এই প্রজন্ম এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের অনেকের ধ্যানধারণায়ও এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। এই বদল কতটুকু ইতিবাচক, তা হয়তো সুনির্দিষ্ট সময়ের পরে গবেষণার বিষয় হতে পারে। অন্যদিকে, পত্রমিতালি বা দূরালাপনে পরিচয়ের সূত্র ধরে সামাজিক সম্পর্কে জড়ানো সংখ্যায় সীমিত হলেও কোনো কালে অবাস্তব ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের রোজেনফেল্ড মিডিয়ার এক সামাজিক গবেষণায় দেখা যায় ৩৯ শতাংশ যুগল এখন অনলাইনে পরিচয়ের সূত্রে সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘সুর অতীত হওয়া গানের মতো’ ভালোবাসার ঘোরহীন সামাজিক সম্পর্ক জোর করে টেনে যাওয়ার একঘেয়ে চেষ্টা থেকে অনেকে বেরিয়ে আসছে। কারণ, ভালোবাসার নতুন ঘোর অবাস্তব নয়। একটি সমাপ্তি বরাবর আরেকটি সূচনার পথ তৈরি করে। ভালোবাসা তাই একজন মানুষের প্রতি আজীবনের দায়বদ্ধতার মানসিক বা সামাজিক নিয়ম থেকে মুক্তির চেষ্টায় রত। মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা বলে, সাধারণ একজন জীবনে গড়ে তিন–চারবার গভীর প্রেমে পড়ে।

যুগ যুগ ধরে লেখাজোখা, চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে যুগল বা একক শরীরকে তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমায়, গানে, কবিতায়, কল্পকাহিনির দৃশ্যে যৌনতার আবহ ভালোবাসাবাসিরই অংশ। আর সাহিত্যে যৌনতার বর্ণনা নতুন কিছু নয়। ডি এইচ লরেন্সের প্রেম ও যৌনতানির্ভর উপন্যাস লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার ১৯২৮ সালে গোপনে প্রকাশিত হলেও ১৯৬০ নাগাদ ইউরোপে তা ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়। আজকের দিনে কাজুও ইশিগুরো বা হারুকি মুরাকামিকে একই রকমের রচনা গোপনে প্রকাশ করতে হয় না। দ্য রিমেইনস অব দ্য ডে, নরওয়েজিয়ান উড বা 1Q84 দ্রুত বহুলপঠিতের তালিকায় স্থান পায়। সমালোচনার পরে জীবনঘনিষ্ঠ এসব সৃষ্টিকে শিল্প হিসেবেই গণ্য করা হয়।

শিল্প তো তা-ই, যা জীবনের কথা বলে কিংবা ইঙ্গিত দেয়। যুগ ও জীবন বদলে যাওয়ার কারণে শিল্পের বিবর্তনে অনেকে ‘হায় হায়’ করে উঠতে পারেন বটে, তবে জীবনের আচার যদি বদলায়, শিল্পসাহিত্যের প্রকাশভঙ্গিও বদলাতে বাধ্য। আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও হয়তো কোনো তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি/ এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি’র চেয়ে ক্রিস ডি বার্গের ‘ক্যারি মি লাইক আ ফায়ার ইন ইয়োর হার্ট’ শুনে বেশি উদ্দীপ্ত হয়ে থাকতে পারে। এটুকুতে রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে যান না।

শিল্প তো তা-ই, যা জীবনের কথা বলে কিংবা ইঙ্গিত দেয়। যুগ ও জীবন বদলে যাওয়ার কারণে শিল্পের বিবর্তনে অনেকে ‘হায় হায়’ করে উঠতে পারেন বটে, তবে জীবনের আচার যদি বদলায়, শিল্পসাহিত্যের প্রকাশভঙ্গিও বদলাতে বাধ্য। আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও হয়তো কোনো তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি/ এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি’র চেয়ে ক্রিস ডি বার্গের ‘ক্যারি মি লাইক আ ফায়ার ইন ইয়োর হার্ট’ শুনে বেশি উদ্দীপ্ত হয়ে থাকতে পারে। এটুকুতে রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে যান না।

ভালোবাসা বা ভালোবাসাবাসির যৌনতা যতটাই খোলাখুলি বর্ণিত, চিত্রিত বা কথিত হোক না কেন, এদের রহস্যের কোনো কূলকিনারা নেই। তাই ভালোবাসা নিয়ে এত আলাপের পরেও যখন রবীন্দ্রনাথের সরল কৌতূহলটি সামনে আসে, ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়,’ তখন সব তালগোল পাকিয়ে যায়!

সত্যিই তো, ভালোবাসা আদতে কী, তা কি কেউ জেনেছে কোনো দিন?

আফসানা বেগম

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর