মলয় কান্তি নন্দীঃ
মুক্তিযুদ্ধকালে ছিলেন পিরোজপুর মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি অফিসার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছেদ করে ট্রেজারীর অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরিনামে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে ধৃত হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। তাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জীপের পিছনে বেঁধে সারা পিরোজপুর শহর ঘুরানো হয়। পরে বলেশ্বর নদীর পাড়ে দাড় করিয়ে গুলিতে ঝাঝরা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। সেদিন ছিল ৫ মে ১৯৭১। শহীদের মৃতদেহের সন্ধান মেলেনি । বলছিলাম শহীদ বুদ্ধিজীবি সাঈফ মীজানুর রহমানের কথা।
নড়াইলের বিশিষ্ট আইনজীবী ২০২১ সালে মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত মৌলবী আফসার উদ্দিন আহমেদ এবং বেগম মতিয়া আহমেদ দম্পতির জেষ্ঠ্য পুত্র শহীদ সাইফুল বারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান–এস,বি,এম মিজানুর রহমান নড়াইল শহরের বর্তমান সাইফ মীজান সড়কের সাইফ ভিলাতে ১৯৪২ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেন। তৎকালীন নড়াইল মহকুমা উচ্চ বিদ্যালয় স্কুলে পড়ে ১৯৫৮ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬০ সালে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। বালক বয়সেই তিনি বাবা আফসারউদ্দিন আহমেদ ও বড়বোন সুফিয়া বেগম বুলবুলের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়তা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেন। এভাবেই তিনি একটি পারিবারিক রাজনৈতিক আবহে বড় হয়ে ওঠেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং স্বীয় মেধা, যোগ্যতা ও একাগ্রতার বলে ক্রমে সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে উন্নীত হন।
ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র সাইফ মীজান আইয়ুবের সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন এবং ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হওয়ার কারনে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয় তাঁর নামে। ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের পত্রিকা সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে ডাকসু নির্বাচনে ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের নির্বাচনে মীজান – রাজ্জাক পরিষদের ভিপি প্রার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রলীগে তিনি ছিলেন অন্যতম সহ–সভাপতি।
এবছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গভর্ণর মোনেম খানের যোগদানের প্রতিবাদে তার গাড়ীতে কাছ থেকে ইট নিক্ষেপে উদ্যত হন এবং ইটসহ উত্তোলিত হাতের ছবি পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপা হয়। এম এ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন (১৯৬৪) শিক্ষা সফরে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার সিদ্ধাস্ত হয়। সাঈফ মীজানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের স্মৃতিচারণমূলক এক লেখা থেকে জানা যায়, এই শিক্ষা সফরের পূর্বে বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর নুরুল ইসলাম তার অফিস কক্ষে সফরপূর্ব এক সভায় সবাইকে যে ব্রীফ করেন তার মধ্যে একটি অনুরোধ তিনি বারবার করেন, ’মীজান ও মেনন (রাশেদ খান মেনন) যেন কোন পাকিস্তানীর সাথে ঝগড়া বিবাদ না করে বা মাথা গরম করে কারো গায়ে হাত না তোলে। সফরকালে শোষণ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে বিতর্ক হলেও হাতাহাতি বা মারপিট হয়নি শেষ পর্যন্ত।’ ড: ফরাসউদ্দিন আরেকদিনের কথা বলেছেন, সামরিক শাসক কর্তৃক ”সাচ্চা পাকিস্তানী” উপাধিপ্রাপ্ত মোনেম খান বাঙ্গালীর স্বার্থ ও সংস্কৃতি বিরোধী একটি বক্তৃতা করলে তার প্রতিবাদস্বরূপ তেজগাও বিমানবন্দরে মোনেম খান রাওয়াল পিন্ডি যাত্রাকালে আ: রাজ্জাক ও রাশেদ খান মেননের নেতৃতে একদল ছাত্রনেতা তাকে ঘেরাও করেন ও প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন। এর ছবিও পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলে দেখা যায় ওই দুইজন শীর্ষ নেতার পাশে সাঈফ মীজানের ছবি। এইসব ছবির কারণে ও বিভিন্ন এজেন্সির নেতিবাচক রিপোর্টের কারণে সরকারী চাকরী পেতে সাঈফ মীজানের বেগ পেতে হয়েছে। ”পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস (PCCS) পরীক্ষায় পাস করেও মীজান চাকরী পাননি। পরে ড: এম এন হুদার হস্তক্ষেপে প্রাদেশিক সরকারে প্রশাসনে মীজানের চাকরী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে তাকে তাঁর চাকরীস্থলেই প্রাণ দিতে হয়েছে,” বলেছেন তাঁর বন্ধু রাশেদ খান মেনন।
তাঁর সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে পরবর্তীতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন– ড: মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের গভর্ণর), আ: রাজ্জাক (পরবর্তীতে আলীগ নেতা), রাশেদ খান মেনন, খালাতো ভাই ও সহপাঠী হায়দার আকবর খান রণো, ড: ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, কবি আসাদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার প্রমুখ এবং নড়াইলের সহপাঠী ও বন্ধুদের মধ্যে আদিত্য কুমার বিশ্বাস (অব; জেলা ও দায়রা জজ), অধ্যক্ষ সৈয়দ মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ (পিয়ার), এডভোকেট মোল্লা খবিরউদ্দিন, এডভোকেট মকবুল হোসেন শিকদার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তাঁর বিশেষ প্রবণতা ছিলো সাহিত্য ও অর্থনীতি এবং এসব বিষয়ে লেখালেখির প্রতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন এবং পরবর্তীতে তিনি অনেক বই বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে লিখেছেন। তার মধ্যে অর্থনীতি অবতরণিকা, ফলিত অর্থনীতি ও পাকিস্তানের অর্থনীতি, Applied Economics and Pakistan Economics, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, Economics Development of Pakistan. তার রচিত কয়েকটি নাটকের মধ্যে প্রবাল, প্রতিবিম্ব, অনেক তারার স্বর উল্লেখযোগ্য এবং এগুলোতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুররহ অন্যান্য স্থানে অভিনয়ও করেছেন। প্রয়াত জননেতা আ: রাজ্জাক এক নিবন্ধে লিখে গেছেন, ”মীজান আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুদের একজন। রাজপথে, মিছিলে, সংগঠনের সার্বক্ষনিক সাথী। সে ছিল অতিমাত্রায় বন্ধু বৎসল। আদর্শিক বন্ধুদের জন্য বিনা দ্বিধায় জীবনের ঝুকি নিতে পারত সে। ”
মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ মিজানুর রহমান ছিলেন পিরোজপুরের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। যুদ্ধের সূচনাতেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনগণ ও পুলিশ বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামনে সে প্রতিরোধ ভেঙ্গে যায়। সেদিন ছিল ৫ মে ১৯৭১। কুখ্যাত রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সরাসরি সহযোগিতায় জল্লাদ দখলদার বাহিনী পিরোজপুরের তদানিন্তন এসডিও, এসডিপিও এবং ট্রেজারী অফিসারকে দেশদ্রোহিতার কথিত অপরাধী হিসেবে ঘোষনা দিয়ে বন্দী করার চেষ্টা করে। প্রথম পর্যায় এসডিও এবং এসডিপিওকে বন্দী করে। এ সময় শহীদ মীজানুর রহমান পিরোজপুর হাসপাতালে আত্ম গোপন করে। তৎকালিন সময়ের পিরোজপুরের মানুষের কাছে শোনা যায় কুখ্যাত রাজাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর সরাসরি সহযোগিতায় জল্লাদ দখলদার বাহিনী দিয়ে পিরোজপুর হাসপাতাল থেকে সাঈফ মীজানুর রহমানকে বন্দী করান এবং খান সেনাদের জীপের চাকায় বেঁধে তাঁকে পিরোজপুরের সারা শহর ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। তাঁকে দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ দেওয়ানোর চেষ্টা করা হয়। তিনি কখনো পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেননি, জয়বাংলা , জয়বাংলা ধ্বনি দিতে থাকলে পাকবাহিনী মিজানুর রহমানেকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করে নদীতে ফেলে দেয়। স্বাধীনতার এই সূর্যসৈনিক লুটিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার কোলে। আজও এই অমর শহীদের লাশের সন্ধান মেলেনি। তাঁর হত্যাকারীদের মধ্যে অন্তত একজনের বিচার হয়েছে। তিনি আমৃত্যু কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে কারান্তরালে দিন অতিবাহিত করছেন।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সাঈফ মীজান স্মরণে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ’স্বাধীনতা পুরস্কার” এ ভূষিত করে ২০১৪ সালে।
■ লেখক সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, আব্দুল হাই সিটি কলেজ নড়াইল, ইমেইল-malaynrl@gmaqil.com







