যুদ্ধ এমন এক বাস্তবতা—যাকে অপছন্দ করার হাজারটা কারণ আছে, তা সত্ত্বেও কখনো কখনো যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। পবিত্র কোরআনে এদিকে ইশারা করেই বলা হয়েছে, ‘তোমাদের ওপর যুদ্ধ ফরজ করা হলো, যদিও এ তোমাদের কাছে অপছন্দ; কিন্তু তোমরা যা পছন্দ করো না, হতে পারে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ করো, হতে পারে তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)
নবীজি (সা.) এই কল্যাণের প্রয়োজনেই যুদ্ধ করেন, ২৭টি যুদ্ধে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেন, এবং একবার গুরুতর আহত হন। যুদ্ধে তাঁর নেতৃত্ব প্রমাণ করে তিনি কৌশলী আক্রমণ বেশি পছন্দ করতেন। নীতিনৈতিকতাকে তিনি সরলরৈখিক মনে করতেন না, বরং স্বাভাবিক অবস্থা ও যুদ্ধকালীন অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করতেন। যেমন ধোঁকা দেওয়া স্বাভাবিক অবস্থায় মন্দ হলেও শত্রুদলকে দুর্বল করার জন্য তিনি এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, এবং খুব ভালোভাবে সফল হয়েছেন।
এ ক্ষেত্রে খন্দকের যুদ্ধের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য, যেখানে তিনি এমন এক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, যা যুদ্ধ ছাড়াই মুসলমানদের বিজয়ী করেছিল।
পঞ্চম হিজরিতে খন্দকের যুদ্ধের সময় মদিনা থেকে নির্বাসিত দুই ইহুদি গোত্র—বনু কায়নুকা ও বনু নাজির মক্কার কুরাইশ ও মদিনার অদূরের গাতফান গোত্রের সঙ্গে জোট বাঁধে। মদিনাতে তখন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কুল্লে তিন হাজার, যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন লোক ছিল বড়জোর এক হাজার। অন্যদিকে বনু গাতফান একাই ছয় হাজার সৈন্য সরবরাহ করে, আর কুরাইশ ও ইহুদিরা দেয় চার হাজার, সর্বমোট হয় ১০ হাজার। মানে একজন মুসলমানের বিপরীতে ১০ জন কাফের। তারা এমনভাবে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় যে এই যুদ্ধের পরে দুনিয়ার বুকে যেন কোনো মুসলমান বাকি না থাকে।
নবীজি (সা.) সম্মুখযুদ্ধ এড়াতে প্রথমত মদিনার ভৌগোলিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন, এরপর পারসিকদের যুদ্ধকৌশল অনুসরণ করে পরিখা খনন করেন। (সীরাতুল মুস্তফা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬৬-২৬৭, ইফাবা)
যুদ্ধ শুরু হলে তিনি সংবাদ পান মদিনায় বসবাসকারী ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করে জোটবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নবীজি (সা.) চিন্তায় পড়ে গেলেন, সামনে ১০ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী, পেছনে বনু কুরাইজার প্রায় ৭০০ সৈন্য, অন্যদিকে তীব্র খাদ্যসংকটে সব মুসলমান দুর্বল হয়ে আছে।
নবীজি (সা.) তখন জোটবাহিনীর মধ্যে ভাঙন তৈরি করতে চাইলেন। তিনি প্রথমে বনু গাতফান, যাদের ছয় হাজার সৈন্য কেবল অর্থের লোভে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছিলেন, তাঁদের একটি ‘অফার’ পাঠান—যদি তাঁরা যুদ্ধ না করে ফিরে যান, তাহলে মদিনায় উৎপন্ন খেজুরের এক–তৃতীয়াংশ তাঁদের প্রদান করা হবে। প্রসঙ্গত বলতে হয়, সেই সময় মদিনাবাসীর প্রধান আয়ের উৎস ছিল খেজুর। এক–তৃতীয়াংশ খেজুর দেওয়া মানে বার্ষিক আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ দিয়ে দেওয়া।
কিন্তু গাতফান গোত্র এই প্রস্তাবে রাজি হলেও মদিনার স্থানীয় সাহাবিরা এ ব্যাপারে শ্রদ্ধার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। শেষতক কোনো বনু গাতফানের সঙ্গে কোনো চুক্তি কার্যকর হলো না। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২০২, ইফাবা)
এমন সময় নুয়াইম ইবনে মাসউদ নামক গাতফান গোত্রের একজন ইসলাম গ্রহণ করে সাহাবিদের দলে আসেন। নুয়াইম (রা.) ছিলেন মুখ পাতলা স্বভাবের মানুষ। তিনি কোনো কথা গোপন রাখতে পারেন না, যা শুনতেন তা-ই প্রকাশ করে দিতেন। ঘটনাক্রমে একদিন এশার সময়ে তিনি নবীজি (সা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে ডেকে নবীজি (সা.) বললেন, ‘এই, এদিকে এসো।’
তিনি এলেন। নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি দেখে এসেছ। ওদিকের খবর কী?’ তিনি বললেন, ‘কুরাইশ ও গাতফানের লোকেরা বনু কুরাইজার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে তারা যেন ওদের সঙ্গে মিলে আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে বনু কুরাইজা জামানত হিসেবে জোটবাহিনীর সম্ভ্রান্ত লোকদের বন্ধক চেয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।’
রাসুল (সা.) নুয়াইমকে বললেন, ‘আমি তোমাকে একটি গোপন কথা বলব, এ কথা তুমি কারও কাছে প্রকাশ করবে না।’
নুয়াইম বললেন, ‘আচ্ছা।’
এরপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘বনু কুরাইজা আমার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে যে ওদের মিত্র বনু নাজিরকে যদি মদিনায় এনে ওদের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ ফিরিয়ে দিই, তাহলে তারা আমার সঙ্গে সন্ধি করবে।’
নবীজি (সা.) এই সময় এ কথাও বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ হলো ধোঁকা। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আমাদের কল্যাণের কোনো একটি ব্যবস্থা করে দেবেন।’
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, সম্ভবত জোটবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে বনু কুরাইজা এই প্রস্তাব পাঠিয়েছিল।
নুয়াইম (রা.) তাদের বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য উপদেশদাতা হয়ে এসেছি, তোমাদের ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতার খবর জানাতে এসেছি।’
যাই হোক, নুয়াইম (রা.) এই ‘সিক্রেট’ শুনতে পেয়ে দ্রুত তার গোত্রের কাছে গেলেন, তাদের বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য উপদেশদাতা হয়ে এসেছি, তোমাদের ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতার খবর জানাতে এসেছি।’ (দালাইলুন নবুওয়াহ লিল বায়হাকি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪০৩-৪০৫)
এরপর তিনি জোটবাহিনীর নেতাদের বনু কুরাইজার সন্ধির প্রস্তাবের কথা জানালেন।
জোটবাহিনী দ্রুত ইকরামা ইবনে আবু জাহলের নেতৃত্বে বনু কুরাইজার কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়, তারা তাদের সেদিনই যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। ঘটনাক্রমে সেদিন ছিল শনিবার। তাই ইহুদিরা শনিবারের দোহাই দিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করে। তারপর তারা আবার পূর্বশর্ত মোতাবেক মানুষ বন্ধক চায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২১৬-২১৭, ইফাবা)
কিন্তু জোটবাহিনীর মনে হয় বনু কুরাইজা তাদের সঙ্গে মোনাফেকি করছে। ফলে তাদের উভয় পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। এভাবেই আল্লাহ তাআলা জোটবাহিনীর ঐক্য নস্যাৎ করে দেন।
সিরাতের কিতাবে এই ঘটনারই অন্য একটি ভার্সন আছে, যেখানে নবীজি (সা.) নন বরং নুয়াইম (রা.) দুই পক্ষের মধ্যে ভাঙনের মূল নায়ক। ইবনে কাসির (রহ.) দুটো ঘটনাই উল্লেখ করেন, তবে এখানে উল্লিখিত ঘটনাকেই ‘আহসান’ (মানগত দিক থেকে সর্বোত্তম) বলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৫৭)
নবীজি (সা.)-এর এই কৌশলের কারণেই কাফেরদের জোটবাহিনী যুদ্ধ না করে ফিরে যায়। এবং মুসলমানদের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয়।
প্রথম আলো







