Friday, December 5, 2025

শোষণের শৃঙ্খলে বন্দী বরেন্দ্রর ১৫ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, পিছিয়ে জীবনমানে

সালমান হাসান রাজিব: জীবনমানের সব সূচকেই একেবারে পিছিয়ে রয়েছে বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় বসবাসকারী প্রায় ১৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, স্যানিটেশনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিত এখানকার সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহালি, সিংহ, ভূমিজ, রবিদাস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। কৃষি কাজে নিম্ন মজুরি এসব উপজাতিদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। শিক্ষার হারেও মূলধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে অনেক পেছনে রয়েছে তারা। ভাষাগত সমস্যা ও বসতি থেকে দূরবর্তী স্কুল—এগুলো শিশুদের লেখাপড়ার প্রধান অন্তরায়। এ ছাড়া উপজাতি পাড়াগুলোয় বছরজুড়ে সুপেয় পানির সংকট লেগেই থাকে।

গোদাগাড়ী উপজেলায় অন্যান্য উপজাতিদের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাঁওতালেরা শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে। ভাষাগত সমস্যার কারণে সাঁওতাল শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষার স্তর শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। বাংলা ভাষায় দুর্বলতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা পেরোনো কঠিন হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলতে থাকায় এ সম্প্রদায়ের হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ রয়েছে।

অধিকাংশ উপজাতি কৃষি শ্রমিক। ধান চাষাবাদে অন্যের জমিতে নারী-পুরুষ উভয়েই শ্রম বিক্রি করেন। ক্ষেত মজুর হিসেবে মাঠ প্রস্তুত, চারা রোপণ, সার দেওয়া, আগাছা পরিষ্কারসহ ধান চাষের সব কাজেই তারা জড়িত। কেউ কেউ জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন, তবে সংখ্যায় তা নগণ্য।

ধান আবাদে খরচ জোগাতে তারা প্রায়শই এনজিও থেকে ঋণ নেন। সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লাভ হাতে আসে না। অনেক সময় ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় লোকসানও গুনতে হয়। প্রান্তিক চাষি হিসেবে সার, বীজ, কীটনাশকসহ সরকারি প্রণোদনা থেকেও বঞ্চিত থাকেন।

শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তন

গোদাগাড়ীর পাকড়ী ইউনিয়নের জাওয়াই পাড়ায় মাহাতো, শীল ও সিংহ সম্প্রদায়ের বাস। কৃষিশ্রমিকের পাশাপাশি জমি লিজ বা বর্গা নিয়ে চাষাবাদ, নাপিতের কাজ, গরু-ছাগল পালন তাদের জীবিকার অংশ। এখানকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় অন্যদের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে। প্রবীণ নারী চঞ্চলা রানি (৭৪) ১৯৭৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। তবে কুসংস্কার ও পরিবারে বাধার কারণে তিনি উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারেননি।

বর্তমানে জাওয়াই পাড়ার অনেক ছেলে-মেয়ে রাজশাহী শহরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। খরচ চালাতে টিউশনি করছে তারা। এখানকার নারীরাও শিক্ষার প্রতি আগ্রহী, তবে বিয়ের কারণে অনেকেই মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। পরে কেউ কেউ আবার ফের পড়াশোনায় যোগ দেয়।

মাটির দেয়াল ও টিনের চালার জীর্ণ কুটিরের ছবিটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের উপজাতি পল্লি আদাড়পাড়া থেকে তোলা।
মাটির দেয়াল ও টিনের চালার জীর্ণ কুটিরের ছবিটি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের উপজাতি পল্লি আদাড়পাড়া থেকে তোলা।

জীবনমান ও বসবাসের অবস্থা

গোদাগাড়ীর বিভিন্ন ইউনিয়নের উপজাতি বসতিগুলো একেবারেই জরাজীর্ণ। মাটির ঘরের দেয়াল ভেঙে পড়ছে, টিনের ছাউনি মরিচায় ক্ষয়ে যাচ্ছে। বর্ষায় কাদায় রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

মান্ডইল রামদাসপাড়ায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র। বরেন্দ্র প্রকল্পের পানিই একমাত্র ভরসা, তবে তা প্রায়শই ময়লা মিশ্রিত। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

সচেতনতা ও সংগঠন

রিইব (রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ) নামের একটি সংস্থা স্থানীয়দের অধিকার বিষয়ে সচেতন করছে। আগে তারা জানত না যে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতার মতো সরকারি সুবিধা তাদের প্রাপ্য। সংগঠনের সহায়তায় তারা ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে আবেদন করছে। উঠান বৈঠক, কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে অবগত হয়েছে।

রিইব তাদের মুষ্ঠির চাল কর্মসূচি শিখিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেক পরিবার এক মুঠ চাল জমা দেয়। বিক্রির অর্থ সমাজিক সমস্যা সমাধানে ব্যয় হয়। সংগঠনের সহায়তায় অনেক নারী দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে।

মজুরি বৈষম্য ও দারিদ্র্য

মাঠে একই কাজ করেও নারী শ্রমিকরা পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পান। পুরুষেরা দিনে ৩৫০ টাকা, আর নারীরা ৩০০ বা তারও কম পান। মৌসুমি কাজ হওয়ায় ধান মৌসুম শেষে তারা বেকার হয়ে পড়ে। তখন পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

রিইব-এর প্রশিক্ষণ ও তথ্য অধিকার ব্যবহারের ফলে অনেক পরিবার সরকারি আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় জমি ও ঘর পেয়েছে।

সাংস্কৃতিক সংকট ও ভূমিহীনতা

বৃদ্ধ রূপলাল হেমব্রম জানান, একসময় এ অঞ্চল জঙ্গলে ভরপুর ছিল। পূর্বপুরুষেরা জঙ্গল সাফ করে জমি চাষের উপযোগী করেছেন। তবুও অধিকাংশ উপজাতি ভূমিহীন।

শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে সাঁওতালরা। বাংলা না জানার কারণে শিশুরা স্কুলে টিকতে পারে না। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় দূরে হওয়ায় শিশুরা নিয়মিত যেতে পারে না। তবে স্থানীয়ভাবে বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত প্রাক-প্রাথমিক স্কুলগুলো কিছুটা পরিবর্তন আনছে।

সরকারি সহায়তা ও ভবিষ্যৎ

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলো সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এককালীন আর্থিক অনুদান ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সহায়তা পায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে কাজ চলছে, শিগগিরই সাংস্কৃতিক মেলার আয়োজন হবে।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি গণেশ মার্ডি বলেন, গোদাগাড়ীর প্রায় ৬০ হাজার আদিবাসী পরিবার সব দিক দিয়েই পিছিয়ে। কম মজুরি, ভূমিহীনতা, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন সংকট, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া—এসব তাদের উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়।

লেখক: সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর