কেশবপুরে প্রতিদিন বাড়ছে পর্যটকদের ভিড়
রনি হোসেন, কেশবপুর (যশোর): যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভরতভায়না গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন নিদর্শন ভরত রাজার দেউল এখন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থীদের পদচারণায় প্রতিদিন মুখরিত হয়ে উঠছে এলাকা। ধারণা করা হয়, সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধমন্দির হিসেবে এই দেউলটি নির্মাণ করা হয়েছিল। স্থাপনার উচ্চতা ভূমি থেকে প্রায় ১১ দশমিক ৮৮ মিটার। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে, আপারভদ্রা নদীর দক্ষিণ পাড়ে এই দেউলটি দণ্ডায়মান।
যশোর শহর থেকে কেশবপুরের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার, আর কেশবপুর শহর থেকে ভরতভায়না গ্রাম ১১ কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে ভিড় জমাচ্ছেন। এলাকাবাসীর দাবি, থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে, যা এলাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে সরকারি প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে—প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা। দেউলকে কেন্দ্র করে শতাধিক দোকান ও বিভিন্ন অবকাঠামো ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক কালীপদ নাথ দীক্ষিত ১৯২২-২৩ সালে ভরত রাজার ঢিবি নিয়ে প্রথম জরিপ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৪-৮৫ ও ১৯৯৬ থেকে ২০১৬-১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা এখনো চলমান। খননে পাওয়া কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, এটি একটি বৌদ্ধমন্দির বলে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হন।
স্থাপনার গঠন ক্রুশাকৃতি, যার কেন্দ্রে বর্গাকার কক্ষ এবং চারদিকে প্রলম্বিত চারটি অভিক্ষেপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি পূর্ব ভারতের মন্দির স্থাপত্যের বিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সোমপুর মহাবিহার, শালবন বিহার ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের নকশার সঙ্গে এ দেউলের মিল পাওয়া যায়।
প্রথম পর্যায়ে দেউলটি বর্গাকার কাঠামো হিসেবে নির্মিত হয়, যার একদিকে প্রবেশপথ ছিল। পরে চারদিকে অভিক্ষেপ যোগ করে এটি ক্রুশাকৃতিতে রূপান্তরিত হয়। উপরের অংশে ছিল একটি চতুষ্কোণাকার ইটের মঞ্চ, যা ভূমি থেকে প্রায় ১১.৮৮ মিটার উঁচু। এই কাঠামোতে ১৪টি বিভিন্ন আকারের প্রকোষ্ঠ ছিল, যা ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এই নির্মাণ রীতিকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা হয়।
খননকালে এখানে পাওয়া গেছে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ফসিল, ষাঁড়ের মাথা ও পোড়া মাটির ফলকসহ বহু নিদর্শন—যা বর্তমানে ভরত রাজার দেউলের যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁদের পূর্বপুরুষরাও দেউলটির ইতিহাস জানতেন না। তাঁদের মতে, দেউলের উপরের অংশে একসময় পাতকূপের মতো একটি গর্ত ছিল। কেউ সেখানে কিছু ফেললে তা আধা কিলোমিটার দূরে আপারভদ্রা নদীতে ভেসে উঠত। ধারণা করা হয়, নদীর তলদেশ দিয়ে মন্দিরে গোপন সংযোগপথ ছিল।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন,
“ভরতের দেউলটি ১৯৮৪ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আনা হয়। পরবর্তীতে খননকালে মানুষের খুলি, হাত, পা ও পোড়া মাটির বিভিন্ন নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, এই বৌদ্ধমন্দিরটি সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত হয়।”







