পবিত্র কোরআনের শততম সুরা ‘আদিয়াত’ অর্থাৎ ‘ধাবমান অশ্ব’—এ এমন এক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যেখানে ঘোড়ার বেগে ছুটে চলা মানুষের উদ্দাম প্রবৃত্তি, আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা এবং ধন-সম্পদের মোহকে তুলে ধরা হয়েছে।
এই সুরাটি তিনটি ভিন্নভিন্ন ভাগে মানুষের অবস্থান ও পরকালীন জবাবদিহিতার দিক নির্দেশ করে।
সুরার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা:
আল্লাহ তাআলা প্রথম পাঁচ আয়াতে শপথ করেছেন এমন অশ্বগুলোর, যারা হু হু করে দৌড়ে বেড়ায়, পায়ের আঘাতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় এবং সকালবেলায় আক্রমণ করে, ধুলিঝড় তোলে এবং শত্রুপক্ষে ঢুকে পড়ে সম্মিলিতভাবে। এই বর্ণনা মূলত এমন সব যোদ্ধা ও তাদের বাহনের জন্য যারা জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে।
এরপর ছয় থেকে আট আয়াতে উঠে এসেছে মানুষের প্রকৃত অবস্থা। আল্লাহ বলেন, মানুষ নিজের প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, অথচ সে নিজেই এই অকৃতজ্ঞতার সাক্ষ্য দেয়। তার হৃদয় ধন-সম্পদের মোহে নিমজ্জিত।
সুরার শেষ অংশে (৯–১১ আয়াত) আখিরাতের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, সেই দিন যখন কবরের অন্তরাল ফাঁস করা হবে, হৃদয়ের সব গোপন কথা প্রকাশিত হবে এবং মানুষকে তার প্রতিপালক জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন।
সারসংক্ষেপ:
সুরা আদিয়াতের প্রথমাংশে ঘোড়ার গতির সঙ্গে তুলনা করে মানুষের বেপরোয়া আচরণকে তুলে ধরা হয়েছে। মাঝের অংশে বলা হয়েছে, এই মানুষ কেমনভাবে নিজের খোদার প্রতি অকৃতজ্ঞ, এবং ধন-সম্পদের মোহে নিজের চরিত্র হারিয়েছে। আর শেষ অংশে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে যে, আখিরাতে তার লুকোনো সব কাজ ও ইচ্ছা প্রকাশিত হবে, এবং তখন তাকে জবাব দিতে হবে তার সব কৃতকর্মের জন্য।
এই সুরা তিনটি মানবিক দুর্বলতা সামনে এনেছে—
ক. মানুষ তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ।
খ. সে জানার পরও কৃতজ্ঞতা ও আখিরাতের ব্যাপারে উদাসীন।
গ. ধন-সম্পদের প্রতি অতি মোহে সে অন্ধ।
আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায়সমূহ:
১. অন্তরের মাধ্যমে: আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের স্বীকৃতি, তাঁর ভয় ও তাকওয়া অবলম্বন করা।
২. ভাষার মাধ্যমে: মুখে আল্লাহর প্রশংসা করা, তাঁর দেওয়া নিয়ামতের শোকর আদায় করা।
৩. কর্মের মাধ্যমে: নামাজ আদায় করা, সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করা এবং অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা।
ঘোড়ার উদাহরণ ও মানুষের শিক্ষা:
যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়াগুলো তাদের আরোহীর আদেশে জীবনপণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেভাবে মানুষকেও তার মনিব আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা উচিত। অথচ মানুষ নিজের খেয়ালখুশির দাস হয়ে আল্লাহর পথে চলতে চায় না, বরং তাঁর নিয়ামত উপভোগ করেও অবাধ্য হয়ে থাকে।
সুরা আদিয়াতের সময়কার আরব সমাজ ছিল হানাহানি, লুটতরাজ আর দস্যুতায় ভরা। আল্লাহর দেওয়া শক্তিগুলো সৎ কাজে ব্যবহার না করে তারা অপব্যবহার করত। সুরা এই বাস্তবতাকে সামনে এনে জানিয়ে দেয়, দুনিয়ার জীবনেই সব শেষ হয়ে যাবে না, বরং মৃত্যুর পর অপেক্ষা করছে এক কঠিন জবাবদিহির সময়। শুধু কাজ নয়, মানুষের অন্তরের নীতিও সেখানে যাচাই করা হবে।
এই সুরা মানুষকে আত্মসমালোচনায় উদ্বুদ্ধ করে, তাকওয়া অর্জনে আগ্রহী করে তোলে এবং মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ সবকিছু জানেন—অন্তরের কথাও, বাইরের কর্মও।







