Wednesday, February 19, 2025

শান্তির প্রতীক মহাত্মা গান্ধী: এক অনন্য জীবনসংগ্রাম

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম অগ্রনায়ক মহাত্মা গান্ধী। অহিংসার আদর্শে অনড় থেকে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, ভারতের স্বাধীনতার মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। আজকের দিনে ফিরে দেখা যাক এই মহান নেতার জীবনসংগ্রাম।

প্রারম্ভিক জীবন

১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ব্রিটিশশাসিত ভারতের গুজরাটের পোরবন্দরে জন্ম নেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তাঁর পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের রাজদেওয়ান। মা পুতলিবাই গান্ধী ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তিনি ছেলেকে ধর্মীয় নীতি ও অহিংসার শিক্ষা দেন, যা পরবর্তী জীবনে মহাত্মা গান্ধীর অন্যতম আদর্শ হয়ে ওঠে।

১৩ বছর বয়সে কস্তুরবা মাখাঞ্জির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মহাত্মা গান্ধী। ১৮৮৮ সালে লন্ডনে গিয়ে আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ফিরে ভারতে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করলেও প্রথম মামলাতেই পরাজিত হন। পরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ভারতীয় ফার্মে কাজ করার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

১৮৯৩ সালে গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় যান এবং সেখানে ভারতীয়দের প্রতি চরম বৈষম্যের শিকার হন। এই বৈষম্য তাঁকে প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করে। ১৮৯৪ সালে তিনি ‘নাটাল ভারতীয় কংগ্রেস’ গঠন করেন এবং অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। ২১ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। এখানেই তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন।

ভারতে প্রত্যাবর্তন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

১৯১৫ সালে মহাত্মা গান্ধী ভারতে ফিরে আসেন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। চম্পারণ (১৯১৭) ও খেদা (১৯১৮) সত্যাগ্রহের মাধ্যমে কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকারের জন্য লড়াই করেন। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের পাশ করা দমনমূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে আসেন।

অসহযোগ আন্দোলন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ব্রিটিশ সেনারা নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করে। এই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাইটহুড উপাধি পরিত্যাগ করেন। গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯২০ সালে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, যা ভারতজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে।

আইন অমান্য আন্দোলন ও দুঃসাহসিক লবণ সত্যাগ্রহ

১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গান্ধী ২৪০ মাইল দীর্ঘ বিখ্যাত ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ বা দাণ্ডি কুচকাওয়াজ শুরু করেন, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রতীকী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়।

ভারত ছাড় আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন

১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেন, যা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে একইসঙ্গে দেশভাগের মাধ্যমে জন্ম নেয় পাকিস্তান, যা গান্ধী মেনে নিতে পারেননি। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে থাকায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের রোষানলে পড়েন।

নাথুরামের গুলিতে গান্ধীর জীবনাবসান

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, দিল্লির বিড়লা ভবনে নাথুরাম গডসে নামের এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী গান্ধীকে তিনটি গুলি ছুঁড়ে হত্যা করে। গুলি লাগার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে মহাত্মা গান্ধী শেষবারের মতো উচ্চারণ করেন, ‘হে রাম!’

গান্ধীর উত্তরাধিকার

মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের দর্শন আজও বিশ্বজুড়ে অনুসরণ করা হয়। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ তাঁর জন্মদিন ২ অক্টোবরকে ‘আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি কেবল ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তি, মানবতা ও অহিংসার এক অবিস্মরণীয় প্রতীক।

- বিজ্ঞাপন

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর