প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো পরাজয় মেনে নেননি। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিজয়ী ভাষণে বিভাজন ভুলে ঐক্যের সমাজ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বলেছেন, এখন আমেরিকাকে ব্যাধি থেকে ‘সারিয়ে তোলার সময়’। বিজয়ী ভাষণ শুনতে বাইডেনের নিজ শহর ডেলাওয়্যারের উইলমিংটনের একটি পার্কিং লটে জমায়েত হন হাজারো মানুষ পাঠকদের উদ্দেশে বাইডেনের দেয়া ভাষণটি তুলে ধরা হলো…প্রিয় আমেরিকাবাসী,
আমেরিকার মানুষ সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। আমাদের পরিষ্কার জয় এনে দিয়েছেন তারা। ‘উই দ্য পিপল’-এর পক্ষের জয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি (সাত কোটি ৪০ লাখ) ভোট পেয়ে আমরা জয়ী হয়েছি। আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, এতে আমি আবেগাপ্লুত। বিভাজন নয়, যিনি সবাইকে এক করার চেষ্টা করবেন, এমন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি, যিনি লাল ও নীল রাজ্য দেখেন না, দেখেন গোটা যুক্তরাষ্ট্রকে। আর যিনি সব মানুষের আস্থা জয়ে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করবেন। এসব নিয়েই আমেরিকা ও তার জনগণ। আর এর জন্যই নিবেদিত হবে আমাদের প্রশাসন। মার্কিন চেতনা ফিরিয়ে আনতেই আমি এই ক্ষমতা চেয়েছিলাম। আর জাতির মেরুদ- মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পুনর্গঠনের জন্য। আমেরিকাকে আবার বিশ্বের কাছে সম্মানিত অবস্থানে নেয়া ও ঘরে ঘরে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কাজ করাই আমার লক্ষ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে ভোট দিয়েছেন লাখো আমেরিকান। এটি আমার জন্য আজীবন সম্মানের বিষয়। এখন এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নই আমাদের সময়ের দাবি।আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আমি জিলের জীবনসঙ্গী। জিল, হান্টার, অ্যাশলে ও আমাদের নাতি-নাতনি, তাদের জীবনসঙ্গী ও পুরো পরিবারের ভালোবাসা ও সমর্থন ছাড়া আজকের অবস্থানে আসতে পারতাম না। তাদের সবার অবস্থান আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়। জিল একজন মা- মিলিটারি মা ও শিক্ষাবিদ। শিক্ষার জন্য তিনি গোটা জীবন উৎসর্গ করেছেন, যিনি শুধু শিক্ষাই দেন না- তিনি শুধুই তিনি। আজ আমেরিকান শিক্ষাবিদদের জন্য একটি দুর্দান্ত দিন। কারণ হোয়াইট হাউসে তারা নিজেদের একজনকে পেতে যাচ্ছেন। আর দারুণ এক ফার্স্ট লেডি হতে চলেছেন জিল। কমলা হ্যারিস- চমৎকার একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে দায়িত্ব পালন করতে পেরে ভীষণ সম্মানিত বোধ করব। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী, প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূত ও প্রথম অভিবাসী কন্যা হিসেবে হোয়াইট হাউসে ইতিহাস রচনা করবেন। এই দিনটির জন্য যারা বছরের পর বছর লড়াই করেছেন, আজ রাতে তাদের স্মরণ করছি। কমলা, ডাগ- পছন্দ করুন আর না করুন- আপনারা পরিবার। আপনারা বাইডেনকে সম্মানিত করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী, যারা এই মহামারির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কাজ করেছেন; স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তা- আপনাদের সবাইকে আমেরিকাবাসীর পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ।আমার প্রচার দল ও সব স্বেচ্ছাসেবীসহ অন্য যারা আজকের এই মুহূর্তটির জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন, তাদের কাছে আমি সবকিছুর জন্য ঋণী। আর আমাদের সমর্থকদের প্রতি- আমরা যে ক্যাম্পেইন তৈরি করেছিলাম ও চালিয়েছিলাম, তার জন্য আমি গর্বিত। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও বহুমুখী যে জোট সবাই মিলেমিশে তৈরি করেছিলাম, সেটির জন্যও গর্বিত। ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান ও স্বতন্ত্র; প্রগতিশীল, মধ্যপন্থী ও রক্ষণশীল; তরুণ ও বৃদ্ধ; শহুরে, উপশহুরে ও গ্রাম্য; সমকামী, স্ট্রেইট, ট্রান্সজেন্ডার; শ্বেতাঙ্গ, লাতিনো, এশিয়ান, নেটিভ আমেরিকান সবাইকে ধন্যবাদ। আর বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকান কমিউনিটি, যারা আমার পক্ষে আবারও সমর্থন দিয়েছেন। তারা সবাই সব সময় যেভাবে আমার সঙ্গে থেকেছেন, আমিও আপনাদের পাশে থাকব।আমি সব সময়ই বলেছি, আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব করে, এমন ক্যাম্পেইনই আমি চাই। আর আমার মনে হয়, সেটি আমরা করতে পেরেছি। প্রশাসনেও এমনটি দেখতে চাই আমি। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থনে যারা ভোট দিয়েছেন, আপনাদের আজ রাতের হতাশা আমি বুঝতে পারছি। এর আগে দুটি নির্বাচনে আমাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল; কিন্তু এখন চলুন, আমরা একে-অন্যকে সুযোগ দিই। কঠোর বাগাড়ম্বর থেকে সরে আসার সময় এটি। তাপমাত্রা কমানোরও। পরস্পরকে আবার দেখা, আবার পরস্পরের কথা শোনার সময়। উন্নয়নের জন্য প্রতিপক্ষকে শত্রু গণ্য করার প্রবণতা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমরা শত্রু নই, আমরা আমেরিকান।
বাইবেল আমাদের বলেছে, সবকিছুরই একটি সময় থাকে- নির্মাণের সময়, ফসল কাটার সময়, বীজ বপনের সময় ও ক্ষত উপশমের সময়। আমেরিকার ক্ষত উপশমের সময় এটি। এখন ক্যাম্পেইন শেষ, জনগণের ইচ্ছা কী? আমাদের ম্যান্ডেটটুকুই বা কী? ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যুদ্ধ। সাফল্য অর্জনের যুদ্ধ। আপনাদের পরিবারের স্বাস্থ্যসেবা নিরাপত্তায় যুদ্ধ। বর্ণবৈষম্য দূর করার যুদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার যুদ্ধ। আমাদের কাজ শুরু হবে কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দিয়ে।ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে না পরলে আমরা অর্থনীতির ক্ষতিপূরণ করতে পারব না, পারব না আমাদের জীবনশক্তি পুনরায় ফিরে পেতে। এমনকি নাতি-নাতনিদের আলিঙ্গন করা, জন্মদিন, বিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনসহ জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলোও উপভোগ করতে পারব না। সোমবার আমি শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞের নাম ঘোষণা করব। তারা বাইডেন-হ্যারিস কভিড-১৯ পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে কাজ করবেন। আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এ প্রকল্প বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হবে। সেই সঙ্গে থাকবে, সহমর্মিতা, সচেতনতা ও সহানুভূতিশীলতা। এই মহামারি নিয়ে আমি কোনো প্রতিশ্রুতি দেবো না। আমি একজন গর্বিত ডেমোক্র্যাট। এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবো। যারা ভোট দিয়েছেন, তারা তো বটেই; দেননি যারা, তাদের জন্যও কঠোর পরিশ্রম করব। আমেরিকার হতাশাময় যুগ অবসানের সময় শুরু হচ্ছে এখন থেকে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের একে অন্যকে সহযোগিতা না করার প্রবণতা কোনো রহস্যজনক কারণে নয়। এটি একটি সিদ্ধান্ত। আমরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমরা যদি একে অন্যকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তাহলে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্তও নিতে পারি। আমার মনে হয়, আমেরিকানরাও এটি চান। তারা আমাদের একে-অন্যের সহযোগী হিসেবেই দেখতে চান। আমি এই সহযোগী মনোভাবই বেছে নেব। কংগ্রেস, ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান- সবাইকে আমি এ মনোভাব পোষণের আহ্বান জানাই। সবার কাছে এই দেশকে বাস্তবে পরিণত করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তাদের কাজ, বিশ্বস্ততা, পরিচয় যা-ই হোক না কেন; সব সময় অস্থিতিশীল সময়ে আমেরিকার পরিবর্তন এসেছে। সেই মুহূর্তেই নিতে হয়েছে কঠোর সিদ্ধান্ত এবং দিতে হয়েছে তার বাস্তব রূপ, যা আমরা হতে চাই। ১৮৬০ সালে লিঙ্কন এসেছিলেন ইউনিয়ন বাঁচাতে। ১৯৩২ সালে এফডিআর দেন অবরুদ্ধ দেশকে নতুন চুক্তি। ১৯৬০ সালে জে এফ কে দেন নতুন সীমান্তের প্রতিশ্রুতি। ১২ বছর আগে বারাক ওবামা সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস। বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা পারি।’ এখন আমরা আবার একটি অস্থিতিশীল সময়ের মুখোমুখি। হতাশাকে পরাজিত করার সুযোগ পেয়েছি আমরা। সুযোগ পেয়েছি একটি উন্নত ও দৃঢ় সংকল্পের দেশ তৈরির। আমরা এটি করতে পারব। আমি জানি, আমরা পারব। আমি দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন চেতনার জন্য সংগ্রামের কথা বলে আসছি। আমরা অবশ্যই সেই চেতনা ফিরিয়ে আনতে পারব। ভালো ও মন্দের মধ্যকার লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতেই আমাদের দেশ গড়ে উঠেছে। এখন সময় সত্যের বিজয়ের। আজ রাতে সারাবিশ্ব দেখছে আমেরিকাকে। আমেরিকা বিশ্বের বাতিঘর বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমরা ক্ষমতার জোরে দৃষ্টান্ত স্থাপন করি না; দৃষ্টান্ত স্থাপনের ক্ষমতার জোরে নেতৃত্ব দিই। আমি সবসময় একটি শব্দ দিয়ে আমেরিকাকে সংজ্ঞায়িত করি- সম্ভাবনা। এই আমেরিকায় সবাইকে তাদের স্বপ্নপূরণের সুযোগ দেওয়া উচিত। সৃষ্টিকর্তা তাদের স্বপ্নপূরণের সব রসদ দিয়েছেন। আমি এই দেশের সম্ভাবনাময়তায় বিশ্বাস করি। আমরা সবসময়ই সামনের দিকে তাকাই। ভবিষ্যতের আমেরিকা অবমুক্ত ও ন্যায়পরায়ণ। ভবিষ্যতের আমেরিকা সততা ও সম্মানের সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। ভবিষ্যতের আমেরিকা ক্যান্সার, অ্যালঝেইমারের মতো রোগ উপশমে ভূমিকা রাখবে। এই আমেরিকা কাউকে পেছনে ফেলে যাবে না। কখনোই কোনো কিছু ছেড়ে দেবে না। মহান দেশ আমেরিকা। আর আমরা ভালো মানুষ। এটিই যুক্তরাষ্ট্র।ক্যাম্পেইনের শেষ দিনগুলোয় আমি কেবল একটি স্তবগানের কথাই ভাবতাম। এটি আমার, আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার মৃত ছেলে বিউর জন্য অনেক অর্থপূর্ণ। এই স্তবগান আমাকে টিকে থাকার শক্তি দেয়। আমি আশা করি এই স্তবগান দুই লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি পরিবারকে সান্ত্বনা দেবে, যারা চলতি বছর বিপজ্জনক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে তাদের স্বজন হারিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি অন্তঃস্থল থেকে সহমর্মিতা জানাচ্ছি। আশা করি, এই স্তবগান তাদের সান্ত্বনা দেবে।
অনলাইন ডেস্কঃ






