বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক বাউ সরিষা-৯ নামে নতুন এক সরিষার জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জাতটি স্বল্পমেয়াদী, উচ্চফলনশীল, রোগবালাই প্রতিরোধী এবং লবণাক্ততা সহিষ্ণু। জাতটির হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় দুই টন যা প্রচলিত অন্যান্য স্বল্পমেয়াদী সরিষার জাত থেকে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ বেশি। নতুন এ জাতটির উৎপাদনকাল ৭৮ থেকে ৮২ দিন এবং বীজে তেলের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা দেশে প্রচলিত সরিষার সাধারণ জাতে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ। প্রতি আড়াই কেজি সরিষা থেকে এক লিটার তেল পাওয়া যাবে। এ বছরের ৩১ মার্চ জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে নিবন্ধন পেয়েছে নতুন জাতটি।
উদ্ভাবিত বাউ সরিষা-৯ ছাড়করণ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসকল তথ্য জানান জাতটির উদ্ভাবক ও প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. আরিফ হাসান খান রবিন। এছাড়া গবেষণা সহযোগী হিসেবে ছিলেন ওই বিভাগের একাধিক স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষক জানান, বাউ সরিষা-৯ চাষের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, অল্টারনারিয়া ব্লাইট, পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণ খুবই কম। জাতটি পরিমিতরূপে বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু হওয়ায় উৎপাদন প্রচলিত অন্যান্য জাতের তুলনায় প্রায় ২০-২৫ শতাংশ বেশি। কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজননের গবেষণা মাঠ এবং বাকৃবির পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদের চর এলাকায় জাতটির পরীক্ষামূলক চাষ করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া গিয়েছে। পাশাপাশি জাতটি স্বল্পমেয়াদী হওয়ায় আমন এবং বোরো ধানের মধ্যবর্তী সময়ে এটি চাষ করা যাবে। ফলে একই জমিতে বছরে চারটি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে যা ফসলের নিবিড়তাও বৃদ্ধি করবে।
পুষ্টি গুণ সম্পর্কে গবেষক বলেন, উদ্ভাবিত বাউ সরিষা-৯ এ অলিক এসিডের পরিমাণ শতকরা ১৬-১৭ শতাংশ, ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের অণুপাত ২৫:১, যা সয়াবিন তেলে ১৮:১। বাউ সরিষা-৯ থেকে প্রাপ্ত তেলের স্মোক পয়েন্ট ২৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড, যা সয়াবিন তেলের তুলনায় প্রায় ১৪ ডিগ্রী বেশী। সরিষার তেলে বিদ্যমান গ্লুকোসিনোনেট বিশ্লেষিত হয়ে আইসো থায়োসায়ানাইট তৈরি হয় যা কান্সার প্রতিরোধী। ফলে, ভোজ্য তেল হিসেবে বাউ সরিষা-৯ সরিষার তেল সয়াবিন তেলের তুলনায় অধিক স্বাস্থ্য সম্মত।
গবেষক আরও জানান, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়। মোট উৎপাদিত সরিষার তেলের বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এই উৎপাদন দ্বারা দেশের মোট ভোজ্য তেলের চাহিদার মাত্র ২০-৩০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়। এ কারণে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ হাজার কোটি টাকার সরিষা, সয়াবিন এবং পাম তেল আমদানি করতে হয়। দেশীয় প্রক্রিয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ৪০ শতাংশ ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় বাউ সরিষা-৯ জাতটি চাষে দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় করা সম্ভব হবে। প্রচলিত অন্যান্য সরিষার জাতের তুলনায় বাউ সরিষা-৯ চাষে হেক্টর প্রতি প্রায় ২৪ হাজার টাকা বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে। সে হিসাবে বছরে ২৪ বিলিয়ন টাকার সরিষার বাজার তৈরি করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেমের (বাউরেস) তিনটি প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সাল থেকে সাত বছর যাবৎ এই জাতটি উদ্ভাবনের গবেষণা করা হয়েছে। বর্তমানে জাতটির অধিকতর উৎকর্ষ সাধনে উচ্চতর গবেষণা চলমান রয়েছে এবং আরও কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
-অনলাইন ডেস্ক