Saturday, December 6, 2025

আরেক মহা প্রতারক আটক

ইউটিউবে এক ভুয়া নবাবের ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। ইউটিউব চ্যানেলটির নাম বঙ্গটিভি। তথাকথিত জনপ্রিয় এই ইউটিউবের উপস্থাপক মায়া রাজ নামে এক ব্যক্তি। যিনি নিজেকে সংবাদকর্মী দাবি করে দর্শকদের সামনে ‘ইতিহাসের কিংবদন্তি’ পরিচয়ে একজনের পরিচয় করিয়ে দেন। মায়া রাজ তার উপস্থাপনায় বলেন, ‘আমাদের আজকের সেলিব্রেটি নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নাতি নবাব আলী হাসান আসকারি। নবাব আসকারি তারুণ্যের অহঙ্কার, বাংলার গর্ব ও আধুনিক ঢাকার রূপকার।’ এ রকম বহু বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয় তাকে। এরপর আলী হাসান আসকারি বঙ্গটিভিতে তার ‘ঐতিহাসিক’ সেই বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। চেহারা ও পোশাকে পুরোটাই নবাবি ছাপ। আসকারি বলতে থাকেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি বাংলাদেশে এসেছি প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। দেশের মানুষের ভালোবাসায় আমি গর্বিত ও আনন্দিত। এরই প্রেক্ষাপটে আজ আপনাদের সঙ্গে আমার পরিচয়। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ একটা ইতিহাস। উনি যা করে গেছেন একশ বছর আগে। তার নিজস্ব জমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেছিলেন। পাশাপাশি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে; যার উনি প্রতিষ্ঠাতা। প্রতি বছর আমরা তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি। এরই ধারাবাহিকতায় মনে হলো আমাদের পরিবারকে বাংলাদেশে আসা দরকার। বাংলার মানুষের সলিমুল্লাহকে রিপ্রেজেন্ট করা দরকার। অনেক ইতিহাস অজানা। সরাসরি চলে যাই অনেক অজানা কাহিনিতে। অনেকে এখন ফেসবুকে লেখালেখি করেন যে, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ সোনালী ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়েছেন। নবাব সাহেবের মৃত্যু একশ বছর আগে।সোনালী ব্যাংকের জন্ম স্বাধীনতার পর। তাহলে কীভাবে আমার নানা ওই ঋণ নিলেন। অনেকে বলেন, দাড়িয়ায় নূর একটা পাথর ছিল। পাথরটা স্বয়ং বুড়িগঙ্গার বুড়ি নবাব সলিমুল্লাহকে উপহারস্বরূপ দিয়েছিল। একদিন দুপুরে যখন নবাব সাহেব আহসান মঞ্জিলের সামনে বসে ছিলেন হঠাৎ করেই বুড়ি পাথরটা দেন। যেটাকে বলা হয় দাড়িয়ায় নূর। অনেকে ইতিহাস জানলেও অনেক সত্য তথ্য জানেন না। যে পাথরটা আমার নানাকে বুড়ি দিয়েছিলেন, সেটা এখন আমার হাতে আছে।’ এটা বলার পরপরই নিজের আঙুলে থাকা একটি পাথর দেখান আসকারি। স্যার সলিমুল্লাহ এটা পরতেন বলে জানান। তারপর এটা আমার দাদা মেজর হাসান আসকারির কাছে ছিল। আমি বাংলাদেশে আসার আগ পর্যন্ত আংটি আমার মায়ের কাছে ছিল। দেশে আসার সময় এটা মা আমার কাছে দেন।’ এই হলো আলী হাসান আসকারির জবানিতে তার নবাব পরিবারের ইতিহাস, যা তিনি ইউটিউব চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
তবে আলী হাসান আসকারি নামধারী এই ব্যক্তি আরেক মহাপ্রতারক। প্রতারণায় তিনি রিজেন্টের মোহাম্মদ সাহেদকেও হার মানিয়েছেন। বলতে গেলে তিনি সাহেদের ‘বাপ’। তিনি আসলে নবাব পরিবারের সন্তান নন। কোথাও নবাব পরিবারের নাতি আবার কোথাও সমাজের বিত্তশালীদের স্বজন পরিচয়ে অভিনব কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই ভুয়া নবাব আলী হাসান আসকারি।
গত বুধবার রাজধানীর মিরপুর থেকে আসকারিকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ইকোনমিক ক্রাইম ও হিউম্যান ট্রাফিক টিম। এরপর যা বেরিয়ে আসে, তা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। ঠিক প্রতারক সাহেদের মতো মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে সমাজের বিশিষ্টজনের সঙ্গে তার বহু ছবি রয়েছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছবি পোস্ট করে নিজের ‘নবাবি’ জাহির করতেন তিনি। আমন্ত্রণ ছাড়াই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হতেন। এ সময় তার আশপাশে ঘিরে থাকত সশস্ত্র একাধিক দেহরক্ষী, যারা ছিলেন অবৈধ।
প্রতারণার জন্য যাদের তিনি টার্গেট করতেন, তাদের কাছে বিভিন্ন সময় একাধিক ভুয়া পরিচয় দিতেন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দপ্তরে যখন প্রতারণা করতে যেতেন, তখন তিনি পরিচয় দিতেন নবাবের নাতি হিসেবে। তিনি প্রচার করতেন, দুবাইয়ে রয়েছে তার স্বর্ণের কারখানা। তার বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার মালিকানা রয়েছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে এমন মালিকানা দাবি করে পোস্টও দেন আসকারি। তিনি জানাতেন তার বাবা রয়েছেন নিউইয়র্কে। বাবার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি। আবার কখনও বলতেন নেদারল্যান্ডসে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তার পরিবার। সেখান থেকে কয়েক বছর আগে ‘সলিমুল্লাহর স্মৃতিচিহ্ন’ হিসেবে এই মহাপ্রতারক আসকারি ঢাকায় ফেরেন। সরকারের একজন উপদেষ্টাকে তার মামা বলে পরিচয় দিতেন। মূলত এসব পরিচয়ের সবই ভুয়া। প্রতারণার জাল ফেলতেই ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করতেন আসকারি।
জানা গেছে, প্রতারণার এসব কাজে আসকারি নবাব পরিবারের অ্যাম্বুশ সিল, ওয়াকিটকি সেট, ভিওআইপি সরঞ্জাম, ল্যাপটপ, একাধিক মোবাইল, সিম কার্ড, অনেককে বিদেশে পাঠানোর ভুয়া মেডিকেল সনদ ব্যবহার করেতেন।
তার প্রতারণার শিকার অসংখ্য। তাদের মধ্যে এক হতভাগ্য হলেন ফেনীর আবু সালমান। তিনি জানান, তার পরিবার ফেনীতে দুমসাদ্দা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ফেসবুকের সূত্র ধরে তার সঙ্গে আসকারির পরিচয় হয়। এক দিন আসকারি তাকে জানান, তিনি নবাব পরিবারের সন্তান। করোনার মধ্যে ফেনীর ওই মাদ্রাসায় তিনি কিছু দান করতে চান। এজন্য সরাসরি ফেনীতে যাবেন। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে সালমানকে আসকারি বলেন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার মালিকানা রয়েছে। সেখানে করোনাকালে ওই হাসপাতালে নার্স, সুইপারসহ বিভিন্ন পদে ৭০০ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। যদি সেখানে লোক নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আর জনপ্রতি যে টাকা পাওয়া যাবে তার পুরোটাই দুমসাদ্দা মাদ্রাসায় দান করা হবে। এরপর আবু সালমান সিঙ্গাপুর গমনেচ্ছুদের খুঁজতে থাকেন। প্রায় ৪০০ ব্যক্তিকে তিনি ঠিক করেন। যারা মাউন্ট এলিজাবেথে কাজ করতে আগ্রহী। তাদের সবার পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র একত্র করা হয়। মেডিকেল সনদ দেওয়ার কথা বলে তাদের দুই দফায় ফেনী থেকে ঢাকায় আনা হয়। মোহাম্মদপুরের ঢাকা ডায়াগনস্টিক ও পল্টনের মেডিনেট নামে দুটি প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতি ৮৫০ টাকার বিনিময়ে মেডিকেল সনদ তৈরি করা হয়। মেডিকেল সনদ তৈরি হওয়ার পর আসকারি এক দিন আবু সালমানকে জানান, ‘স্কিল’ সার্টিফিকেট ছাড়া সিঙ্গাপুর সরকার কাউকে নেবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার পরামর্শ দেন তিনি। তবে কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর সালমান এই ভুয়া নবাব আসকারিকে জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এমন সনদ পাওয়া সম্ভব নয়। তখন আসকারি তাকে আকাশ নামে এক ব্যক্তির ফোন নম্বর দেন। আকাশকে মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের অফিসার বলে পরিচয় করিয়ে দেন। আকাশকে আবু সালমান ফোন করার পর তিনি জানান, ‘বর্তমান বাস্তবতায় সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষতার সনদ পাওয়া কঠিন। তবে যেহেতু নবাব সলিমুল্লাহর নাতি অনুরোধ করেছেন, তাই চাকরির ঝুঁকি থাকলেও সনদ বের করে দেবেন তিনি। এই বাবদ জনপ্রতি ৭৫ হাজার টাকা দিতে হবে। এই কৌশলে প্রায় ৪০০ জনের কাছ থেকে ৭৫ হাজার করে মোট চার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এরপর ওই ৪০০ ব্যক্তি সিঙ্গাপুর যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। তারা ফোন করেন আকাশকে। বিপদ টের পেয়ে আকাশ ও তার গুরু ভুয়া নবাব মোবাইল ফোন বন্ধ করে সটকে পড়েন।
পুলিশের তদন্ত সূত্র জানায়, ব্যাংকের ঋণ পাইয়ে দেওয়া, ইউরোপে লোক পাঠানো, বড় বড় কাজ প্রভাব খাটিয়ে আদায় করে দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রচুর মানুষকে ফাঁদে ফেলেছেন এই বাটপার আসকারি। তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে আসকারি স্বীকার করেছেন, নবাব পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই। মূলত তিনি একজন বিহারি। প্রতারণা করেই নবাব পরিবারের সদস্য হিসেবে জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন আসকারি। কীভাবে গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে নবাবের নাতি পরিচয়ে পরিচয়পত্র পেলেন, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তার প্রকৃত নামের ব্যাপারে এখনও মুখ খোলেননি আসকারি। স্যার সলিমুল্লাহ পরিবারের সদস্য আমানুল্লাহ আসকারিকে বাবা হিসেবে পরিচয় দিতেন আলী হাসান আসকারি। ইতিহাসে জানা যায়, সত্যিকারের নবাব পরিবারের সন্তান আমানুল্লাহ আসকারির দুই মেয়ে। তাদের কোনো ছেলে ছিল না। প্রশ্ন হলো, তাহলে কীভাবে আমানুল্লাহকে বাবা বলে পরিচয় দিতেন- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এই মহাপ্রতারক বলেন, ‘নবাব পরিবারের ইতিহাস কতজন আর পরিস্কারভাবে রাখেন। কেউ এ নিয়ে তেমন ঘাটাঘাটিও করেন না।’সর্বশেষ ঢাকা-১০ আসনের এমপি পদেও হারিকেন মার্কায় নির্বাচন করেছেন এই প্রতারক আসকারি। নির্বাচনে নবাব পরিবারের ভুয়া এই উত্তারাধিকার মাত্র ১৫টি ভোট পেয়েছিলেন।কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ইকোনমিক ক্রাইম ও হিউম্যান ট্রাফিক টিমের এডিসি তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আসকারি একজন বহুমুখী মহাপ্রতারক। তার প্রতারণার কৌশল শুনে আমরাও বিস্মিত। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি, তাতে দেখা যায় পুরান ঢাকায় তার জন্ম। চুয়াডাঙ্গার এক নারীকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে দুই সন্তান। বর্তমানে দারুস সালামে শীতল ছায়া এলাকায় বসবাস করেন। আসকারির আরও পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা একটি বড় ধরনের সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র।

অনলাইন ডেস্ক

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর