মোঃ হাবিব ওসমান, ঝিনাইদাহ প্রতিনিধিঃ আমাদের দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। সবকিছুই থেকে বঞ্চিত অধিকাংশ এই মধবিত্ত সমাজ। এই শ্রেনীর মানুষ কষ্টের শেষ প্রহর পর্যন্ত অপেক্ষা করে, সামান্য একটু সূখের আশায়। কিন্তু সূখ নামক শব্দটা তাদের ধারে কাছেও আসেনা। লোক লজ্জা আর মান-সম্মান বোধের কাছে তারা বড়ই অসহায়। কষ্টে অন্তরের বোবা কান্না তারা অন্তরেই রেখে দেয়। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারে না। মধ্যবিত্তের সকল চিন্তা এবং সাহস সহসায় বিলিন হয়ে যায়। মধ্যবিত্তের জীবন বড়ই কঠিন। এই ধরনের জীবন মানেই মনের মতো করে গড়ে তুলা কিছু স্বপ্ন ও আশাকে নিজের হাতেই গলা টিপে হত্যা করা।
মধবিত্তের অভাব যেন পিছু ছাড়ে না, সুখ শব্দটা যদিও অপেক্ষিক, ধরতে গেলে ধরা দিতে চায় না। জীবন-যাপনের কষ্টের কথা এরা খুব কমই প্রকাশ করে। অথচ সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কাজের শ্রমে মধ্যবিত্তের মানুষের অবদান অপরিসীম। মধ্যবিত্তের শ্রেণির লোকদের কষ্ট মোচন ও মানবিক উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসে না। না সমাজ, না রাষ্ট্র। মধ্যবিত্ত সমাজ জীবনের পুরোটা সময় যুদ্ধ করে বাস্তবতার সঙ্গে। পৃথিবীর সমস্ত কঠিন বাস্তবতা যেন তাদের ঘিরেই তৈরি হয়। এক অদৃশ্য দেয়াল ঘিরে থাকে তাদের এই অদৃশ্য দেয়াল তারা টপকাতে পারেনা। মধ্যবিত্তরা রয়ে যায় জয়-পরাজয়ের ঠিক মাঝখানটাতে।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই থাকে। যার প্রভাবে আমাদের অর্থনীতিতে সীতার অগ্নি পরীক্ষার মতোই। দীর্ঘমেয়াদের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো। আর সবচেয়ে বেশি লাভবান খাদ্যপণ্য, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা। এক সময় বেসরকারি খাতে চাকরি করলে মালিকরা আমৃত্যু দেখতেন। এমনকি গ্রামের যে সব বড় মহাজন শ্রেণীর ব্যবসায়ী ছিলেন, তারা তাদের কর্মচারীদের আজীবন দেখাশোনা করতেন। অনেকে তো তাদের পরিবারের অংশ বলেই মনে করতেন। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও কোম্পানির মালিকরা কারও চাকরি খেতেন না। কর্মচারীরাও বিশ্বস্থতার সঙ্গে সেবা দিয়ে যেতেন। আগের দিনে প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরিরত অবস্থায় কেউ মারা গেলে মালিকরা সেই কর্মচারীর সৎ কাজ এবং খানা করার টাকা দিতেন। মৃত কর্মচারীর সন্তানকে ওই কোম্পানিতে চাকরি ব্যবস্থাও করতেন। আজকে আর এ অবস্থা নেই। আজকে সরকারি চাকরি হচ্ছে সবচেয়ে লোভনীয়। সরকারি চাকুরিতে বাড়ি করার জন্য ঋণ আছে স্বল্প সুদে, গাড়ি আছে এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে অর্থিক সুযোগ এবং পদোন্নতিরও সুযোগ আছে।
বেসরকারি খাতের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন সরকারি চাকরীজীবিরা। তাছাড়া বেতন পাই, কাজ করলে ‘ওভারটাইম’ পাই। এসব খবর প্রতিদিন প্রিন্ট মিডিয়ায় এবং ইলেকট্রিক মিডিয়ায় প্রচার হয়। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেকেই বলছেন মূল্যস্ফীতি রোধ না হলে এই শ্রেণির সংখ্যা কমে যাবে। জাতীয় আয় অথবা মাথাপিছু আয়ের যে অঙ্ক সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়, তা একটি ‘গড়ের’ হিসাব। এরমধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির আয়ের হিসাব যেমন থাকে, তেমনি থাকে সবচেয়ে গরিব লোকের আয়ের হিসাবও। এমনকি যার কোনও আয়ই নেই, তার হিসাবও এর মধ্য ধরা হয়। কোনও দেশের মোট জাতীয় আয়কে সেই দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় বের করা হয়। এতে দেশের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত হয় না। ধনী-গরিব সব সমান হয়ে যায়। শুভঙ্করের ফাঁকি আসলে এখানেই।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির হিসাবটি বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। হ্যাঁ, ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এটা সত্যি, তবে তা কিছু লোকের, যাদের সম্পদের নেই কোনও সঠিক পরিসংখ্যান। দেশ যখন নিম্ন আয়ের থেকে মধ্যম আয়ের দিকে যাচ্ছে তখন কীসের আশায়, কীসের নেশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের তরুণরা দেশ ছাড়ছেন? দেশের জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বাড়লেই যে সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বা ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, অর্থনৈতিক সূত্র কিন্তু তা সমর্থন করে না। মাটি এক জায়গায় উঁচু করতে হলে, অন্য জায়গায় নিচু করতে হয় এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দেশে একজন কোটিপতি তৈরি হলে, তার জন্য হাজার হাজার মানুষকে আধপেট খেয়ে থাকতে হয়। অনেককেরই নিঃস্ব হতে হয়।
বর্তমান সময়ে মানুষের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারনে ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে। প্রতিটা পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ বৃদ্ধি, যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধি, পরিবারে অসুস্থতা, নাশতার বাড়তি দাম, বাসাভাড়া বৃদ্ধির মতো কারণগুলো যুক্ত হয়ে জীবনযাত্রায় অনেক কাটছাঁট করে এখন চলতে হচ্ছে। এজন্য মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই আজ বাজার ব্যয় কমিয়েছেন, ছুটির দিনে বেড়ানো বাদ দিয়েছেন, স্বজনদের বাড়িতে কম যান, মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় বাদ দিয়েছেন, ফল কেনেন না, নিমন্ত্রণ এড়িয়ে চলেন, চা-নাস্তা খাওয়া বাদ দিয়েছেন, রিকশা বাদ দিয়ে হেঁটে চলার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন। অথচ এই মানুষদের বাদ দেয়া বিষয়গুলো ছিল প্রাত্যহিক জীবনেরই অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা খুবই সুযোগ সন্ধানী। উৎসব যেমন ঈদ, রোজা, পূজা, কিংবা ঋতুভিত্তিক সময় শীত, বর্ষা, গরম যে কোনো উপলক্ষ্যেই ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিতে সময়ক্ষেপণ করেন না। মানুষের মৌলিক চাহিদা হচ্ছে-অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। এ মৌলিক চাহিদাগুলো মিটিয়ে একটু বিনোদন কিংবা বিলাসিতার সুযোগ খুঁজবে সেই পথ খোলা নেই। মধ্যবিত্তের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক খাবার এখন বিলাস দ্রব্যে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে। চাওয়া পাওয়ার যন্ত্রণা লুকাতে লুকাতে তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন। যদি তা না হয়, তাহলে তার জীবনযাপন কখনও স্বস্তিদায়ক বা স্বাচ্ছন্দ্যের হবে না। এজন্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের পাহাড়সম আয় বৈষম্যও দূর করা জরুরী। আয় বৈষম্য কমানোর জন্য ধনী শ্রেণির কাছ থেকে সঠিক পন্থায় কর আদায় করে জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যয় করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনির মানুষের কথা মাথায় রেখে অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে নানা সম্মানজনক প্রণোদনার আওতায় এনে বেঁচে থাকার লড়াইকে সর্বত্বক সমর্থন জানাতে হবে।
আর কে-০২







