বিশেষ প্রতিনিধিঃ সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিশোর-কিশোরীদের গান, আবৃত্তি, কারাতের মতো সৃজনশীল এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা এবং জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, মাদক প্রতিরোধ, নারী ও শিশু পাচার, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করতে স্থাপন করা হয়েছে কিশোর-কিশোরী ক্লাব।
ক্লাবের সদস্য এসব কিশোর-কিশোরীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে স্বাস্থ্যকর নশতা। কিশোরী সদস্যদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে স্যানেটারি টাওয়েল। ক্লাব পরিচালনার জন্য রয়েছে ১৩ সদস্যের ক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটি(সিএমসি)। তাঁদের সম্মানী এবং কমিউনিটি মিটিংয়ের জন্য রয়েছে বরাদ্দ।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার পাঁচটি কিশোর-কিশোরী ক্লাব ঘুরে কোথাও সদস্যদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি চোখে পড়েনি। কিশোর-কিশোরীদের নাশতা স্বাস্থ্যকর নয়, দেওয়া হয় না কিশোরী সদস্যদের স্যানেটারি টাওয়েল। ক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা তাঁদের সম্মানী নিলেও কমিউনিটি মিটিং হয় না। ক্লাব সমন্বয়কারী হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের রাখা হয়েছে। তবে তাঁরা ক্লাবে কখনো আসেন না। শুধু স্বাক্ষর দিয়ে দুই হাজার টাকা বেতন তুলে নিয়ে যান। এখন সম্মানী বন্ধ থাকায় আর আসেন না।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন’ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুসারে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত গান, আবৃত্তি, কারাতের মতো সৃজনশীল এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সমাজের বিভিন্ন স্তরের কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করাসহ জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও মাদক প্রতিরোধ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করা এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
প্রতিটি ক্লাবে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী ২০ কিশোরী ও ১০ কিশোর— মোট ৩০ জনকে সদস্য করা হয়। প্রতিটি ক্লাবে একজন গানের শিক্ষক, একজন আবৃত্তির শিক্ষক থাকবে। এ ছাড়া প্রতি উপজেলায় দুই জন জেন্ডার প্রমোটার, একজন কারাতে প্রশিক্ষক থাকবে। তদারিকর জন্য থাকবে একজন ফিল্ড সুপারভাইজার।
প্রতি ক্লাবে ৩৫ জনের জনপ্রতি ৩০ টাকা হিসাবে ১ হাজার ৫০ টাকার নাশতা বরাদ্দ হয়। প্রকল্প কার্যক্রম অনুসারে, পুষ্টির চাহিদা বিবেচনায় নাশতায় সেদ্ধ ডিমের সঙ্গে কেক, বাটার বান, মৌসুমি ফল, মিষ্টি, দই যে কোনো একটা কিছু থাকার কথা। ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব স্থাপন (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প মেয়াদ ২০১৮ সালে শুরু, শেষ ২০২৩ সালে। প্রকল্পের আওতায় যশোর জেলায় ১০১টি ক্লাব স্থাপন করা হয়।
গত এপ্রিল ও মে মাসে কয়েক দফা অভয়নগর উপজেলার পাঁচটি ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, ক্লাবগুলোতে দেওয়া নাশতা স্বাস্থ্যকর নয়। ক্লাসে অনুপস্থিত কিশোর-কিশোরীদের নাশতা রেখে দেওয়া হচ্ছে। পরের ক্লাসে এই নাশতা দেওয়া হবে। কারাতে প্রশিক্ষকেরা অনিয়মিত। জেন্ডার প্রমোটররা ঠিকমতো ক্লাস করেন না। ক্লাবে তবলা থাকলেও তবলচি নেই। সমন্বয়কারী হিসেবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের নারী সদস্যরা নিযুক্ত থাকলেও সম্মানী বন্ধ হওয়ায় তাঁরা আসেন না। তাঁদের দায়িত্ব ছিল, এলাকার কিশোর-কিশোরীদের উদ্বুদ্ধ করা ক্লাবে যুক্ত ও নাশতা বিতরণ করা।
ক্লাবসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আবৃত্তি ও গানের শিক্ষকেরা এক দিনে ৫০০ টাকা পান। ক্লাসে যাতায়াত, ক্লাস অনলাইনে আপলোড করতে ইন্টারনেট ডেটা প্যাক ব্যবহার, উপজেলা কার্যালয় এবং নির্ধারিত দোকান থেকে নাশতা এনে বিতরণ ইত্যাদি দায়িত্ব শিক্ষকদের। পারিশ্রমিক যা পান, তার বড় অংশ এভাবে খরচ হয় বলে শিক্ষকেরা আগ্রহ বোধ করেন না। একজন কারাতে প্রশিক্ষক মাসে ১৫ হাজার টাকা পান।
২৮ এপ্রিল বিকেলে অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আবৃত্তির ক্লাশে ১২ জন কিশোর-কিশোরী উপস্থিত আছে। এর মধ্যে সাত জন কিশোর এবং পাঁচ জন কিশোরী। নাশতা রয়েছে একটি ড্রাই কেক, একটি জুস এবং একটি বিস্কুট। কিশোরী পূজা পাল বলে, এ পর্যন্ত একদিন কারাতে ক্লাশ হয়েছে। জেন্ডার ক্লাশ দুই-তিন দিন হয়েছে। তবে গানের ক্লাশ ও আবৃত্তির ক্লাশ নিয়মিত হয়। নাশতায় কোনোদিন ডিম বা ফল পাইনি।
আবৃত্তির শিক্ষক রহিমা খাতুন বলেন, মাসে একবার উপজেলায় যেয়ে আমাদের এক মাসের নাশতা আনতে হয়। প্রতি ক্লাসে কী পরিমাণ নাশতা থেকে গেলো তা জেন্ডার প্রমোটারকে জানাতে হয়। পরের মাসে সেটা তিনি সমন্বয় করেন। ২৯ এপ্রিল নওয়াপাড়া শংকরপাশা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নতুন ভর্তি সদস্যের সঙ্গে পুরোনোরাও রয়েছে। উপস্থিত চার জন কিশোর এবং ছয় জন কিশোরীর মধ্যে দুই জন কিশোর গত বছরের শিক্ষার্থী ছিল। তাদের একজন জয়েশ বিশ্বাস বলে, আমি গতবছর ক্লাশ করেছি। এ বছরও করছি।
ওই বিদ্যালয়ের আবৃত্তি শিক্ষক নুসরাত জাহান বলেন, নাশতায় কখনো কেক, বিস্কুট, ড্রাই কেক, জুস দেওয়া হয়। তবে ডিম বা ফল দেওয়া হয় না। অফিস থেকে যে নাশতা দেয় তাই আমরা শিক্ষার্থীদের দেই। পায়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আটজন কিশোরী ক্লাশ করছে। এর মধ্যে নতুন ক্লাশে এসেছে তিন জন।
কিশোরী মরিয়ম খাতুন বলে, আমাদের কখনো স্যানেটারি টাওয়েল দেওয়া হয়নি। নাশতা দিয়েছে জুস, ড্রাই কেক ও বিস্কুট। বিদ্যালয়ের গানের শিক্ষক তন্ময় বিশ্বাস বলেন, এখানে হারমোনিয়াম ও তবলা আছে। কবে তবলচি নেই। আমি নিজেই কখনো হারমোনিয়াম এবং কখনো তবলা বাজাই।
বাগদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে আবৃত্তির ক্লাশে ১৬ জন কিশোর-কিশোরীকে উপস্থিত দেখা যায়। জেন্ডার প্রমোটার এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে ক্লাশ না নিয়ে চলে গেছেন। সুন্দলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, চার মাসে ওই ক্লাবেও কারাতে প্রশিক্ষক একদিন এসেছেন। জেন্ডার প্রমোটার একদিন এসেছেন। ক্লাবের সদস্যরা তাঁকে চেনে না। বিদ্যালয়ে উপস্থিত আট জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে দুই জন কিশোরী দুটি নুডলস দেখিয়ে বলে, গত ১৪ এপ্রিল ক্লাবে উপস্থিত ১০ জনের মধ্যে নয়জনকে এই নুডলস দেওয়া হয়েছে।
এর গায়ে লেখা মেয়াদ গত ফেবরুয়ারি মাসে শেষ হয়েছে। মেয়াদ শেষ এজন্য তারা নুডলস খায়নি। আবৃত্তির শিক্ষক লিজু ইয়াসমিন বলেন, আগের বেচে যাওয়া এই নুডলস আমি দিয়েছি। এসময় মেয়াদোত্তীর্ণ বিষয়টা আমি খেয়াল করি নাই।
জেন্ডার প্রমোটার ইমা রায় বলেন, ‘উপজেলা অফিস আমাকে যেভাবে বলে সেভাবে আমি নাশতা সরবরাহ করি। তবে আমি ঠিকমতো ক্লাশ করি।’ ক্লাবের কারাতে প্রশিক্ষক মো. হায়দার আলী বলেন, তাঁর ওপর ২৭টি ইউনিয়নের দায়িত্ব। তিনি নিয়মিত শেখান। গত মাসেও (এপ্রিল) তিনি ক্লাবে গিয়েছেন। পরে তাঁকে প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে এজন্য তিনি আর ক্লাবে যাচ্ছেন না। অভয়নগর উপজেলা ফিল্ড সুপারভাইজার মিতা মন্ডল বলেন, ‘আমার যানবাহন নেই, ফুয়েল নেই।
এইজন্য সব সময় ফিল্ড ভিজিটে যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে আমি নিয়মিত ই-ভিজিট করে থাকি।’ প্রতিটি ক্লাব এলাকায় বছরে দুটি সিএসসির সভা হওয়ার কথা। প্রতিটি ক্লাবে সিএমসি সদস্যদের সম্মানী ও সভার ব্যয় হিসাবে ৩ হাজার ৬০০ টাকা বরাদ্দ আছে। ক্লাবগুলো ঘুরে জানা গেছে, কোনো ক্লাবে সভা হয় না। তবে সম্মানী পান সদস্যরা।
এ ছাড়া প্রতি ক্লাবে প্রতিটি জাতীয় দিবস উদযাপনে বরাদ্দ এক হাজার টাকা। জাতীয় দিবসে গান, আবৃত্তি ও খেলাধুলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কারের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। সাথে উপস্থিত কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সকল সদস্যের জন্য নাশতাও দিতে হবে। কিন্তু দায়সারা গোছের জাতীয় দিবস উদযাপন করা হয়। সেদিন ঠিকমতো নাশতাও দেওয়া হয় না।
অভয়নগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রাজ কুমার পালের সাথে কথা বললে তিনি জানান, শুরু থেকে সিএমসি মিটিং উপজেলায় করে থাকি, সিএমসি সদস্যদের সকলে মিটিংএ উপস্থিত হয়।
খাবার তালিকায় যা আছে তা দেওয়া হচ্ছেনা জানতে চাইলে তিনি চোটে গিয়ে বলেন, এই গরমের সময় ডিম দিয়ে বাচ্চাদের অসুস্থ্য করতে বলেন। মৌসুমী ফলে দেওয়ার কথা আছে কিন্তু ফল পঁচে যায় ভয়ে তা দেওয়া হয় না। পরিবহরে সুবিধার কথা মাথায় রেখে শুকনা খাবার সরবরাহ করা হয়। যে সকল খাবার বেচে যায় তা পরে সমন্নয় করা হয় এবং সেই বেচে যাওয়া খাবারের টাকা দিয়ে বিভন্ন দিবস সহ অন্যান্য খরচ দেখানো হয়।
মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার দেওয়া অতান্ত দু:খ জনক আমি এই বিষয়ে তিন জন কে শোকজ করেছি এবং তিন দিনের মধ্যে তার উত্তর দিতে বলেছিলাম। তারা যে উত্তর দিয়েছে তা সন্তশ জনক হয়নি।
পরবত্তি ব্যবস্থা গ্রহনের প্রস্ততি চরছে। যশোর জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
আর কে-০৪







