সৈয়দ নাইমুর রহমান ফিরোজ, নড়াইল প্রতিনিধিঃ সীমিত আয়োজনের মাধ্যমে আজ ১০ আগস্ট বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতানের ৯৭ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। শিল্পীর জন্মবার্ষিকীতে প্রতিবার বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকলেও গত বছর থেকে করোনা পরিস্থিতির কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এবারও সীমিত আয়োজনের মধ্যে আজ (১০ আগস্ট) ছিল সকাল ৯টায় শহরের কুড়িগ্রামস্থ সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার অভ্যন্তরে সমাহিত শিল্পীর মাজারে পুস্পমাল্য অর্পণ, কোরআন খানি, মিলাদ মাহফিল এবং মিষ্টি বিতরণ। ১৯২৪ সালের এই দিনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই শিল্পী নড়াইল শহরের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বেলায় শিল্পী সুলতানের মা মারা যাবার কারনে তিনি রাজমিস্ত্রী বাবা মেছের আলীর কাছে কাছে থাকতেন। এ সময় বাড়ির পাশে নড়াইল জমিদারবাড়িতে বাবার সুনিপুন হাতে গড়া জমিদারবাড়ির কারুকার্যখঁচিত বিভিন্ন দালান, সুউচ্চ মিনার, নকশা, সিংহদ্বারে অঙ্কিত নানান চিত্র, মূর্তি ইত্যাদি শিশু সুলতানের মনের গভীরে প্রভাব ফেলেছিল। লেখাপড়ার ফাঁকে রাজমিস্ত্রি বাবাকে এসব কাজে সহযোগিতা করতেন এবং ছবি আঁকতেন।
১৯৩৩ সালে শহরের রূপগঞ্জ আশ্রম স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালিন সময়ে স্কুল ভিজিটে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জ্জী। রিসিভশনের সময় গেটে দাঁড়িয়েই তার ছবি এঁকে ফেললেন শিশু সুলতান। রাশভারী উপাচার্য নিজের সুন্দর ছবি দেখে তার পিঠ চাপড়ে বললেন ‘সাবাস’! এভাবে নড়াইলের তৎকালিন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সুদৃষ্টিতে পড়েন এবং এ সূত্র ধরেই ১৯৪১ সালে তিনি সুলতানকে কলকাতায় নিয়ে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও শিল্প-সমালোচক কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য অধ্যাপক সায়েদ
সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। এ সময় সায়েদ সোহরাওয়ার্দির বিশেষ অনুরোধেই সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৪৪ সালে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে চতুর্থ বর্ষে উত্তীর্ণ হলেও সুলতান স্কুল ছেড়ে কাশ্মিরের পাহাড়ি অঞ্চলে উপজাতীয়দের সাথে বসবাস শুরু করেন এবং তাদের জীবনযাত্রার ওপর ছবি আঁকতে থাকেন। ১৯৪৬ সালে কাস্মিরের সিমলায় এক কানাডিয়ান মহিলার সহযোগিতায় সুলতানের প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানের লাহোরে চলে আসেন। সেখানকার শিল্পীদের সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে লাহোরে তার দ্বিতীয় এবং করাচীতে তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয়।
১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিনিময় কার্যক্রমের আওতায় শিল্পী সুলতান তৎকালীন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। নিউইয়র্ক একচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় আমন্ত্রিত ৪৫টি দেশের শিল্পীদের নিয়ে ব্রকলিন আর্ট ইনস্টিটিউটে প্রদর্শনীতে তিনি বিশেষভাবে পুরস্কৃত হন। এছাড়ও এ সময় আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে আরও ১৩টি একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ওই বছরেই লন্ডন সফরে ভিক্টোরিয়া এমব্যাংকমেন্টে তার ছবি প্রদর্শিত হয়। গ্রাম বাংলার জীবন্ত ছবি দেখে মুগ্ধ হন ইংরেজরা। পরে লন্ডনের লেইস্টার গ্যালারিতে আরও একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে স্থান পায় সুলতানের দু’টি ছবি। সেখানে সালভাদর দালী, পাবলো পিকাসো, ডুফি, মাতিস, ক্লী ও কর্নেটোর মত জগৎ বিখ্যাত শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হলেও সুলতানের চিত্রকর্মে সারা ইউরোপে আলোচনার ঝড় ওঠে। এরপর শিল্পী সুলতান হয়ে ওঠেন বিশ্ববরেণ্য। ১৯৫৩ সালের দিকে সবার অলক্ষে পাকিস্তানের করাচি থেকে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। এরপর ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৮৬সালে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ১৯৯৩ সালে শিল্পাঙ্গনে জলরঙ প্রদর্শনী ও শিল্পকলা একাডেমিতে তার শেষ প্রদর্শনী হয়। এর পরের বছর ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে তার ছবির মরণোত্তর প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে।
১৯৫৫ সালের দিকে বহেমিয়ান এই শিল্পী নড়াইলের পুরুলিয়া গ্রামে তার মামা বাড়ির এলাকায় বিশাল জঙ্গলে ভরা একটি পুরোনো পোড়ো বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সেখানে কয়েক বছর থেকে স্থানীয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা পরিস্কার করে “নন্দন কানন ফাইন আর্ট এন্ড স্কুল” নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কাজ শুরু করেন। নড়াইলের অন্যতম এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান নাম “চাঁচুড়ী-পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়”। শিল্পী সুলতান শিশুদের খুব ভালো বাসতেন। তিনি ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে যশোর এম.এম কলেজের একটি পুরোনো হোষ্টেলে “একাডেমী অব ফাইন আর্ট স্কুল” নামে একটি স্কুল গড়ে তোলেন। বর্তমানে এটি “চারুপীঠ” নামে পরিচিত। ১৯৭৮ সালের দিকে নিজস্ব উদ্যোগে জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় “ফাইন আর্ট স্কুল” এবং ১৯৮৭ সালে নড়াইলের কুরিগ্রামে “শিশুস্বর্গ” নামে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিল্পীর মৃত্যুর পরও সুলতান কমপ্লেক্স ভবনে এ “শিশুস্বর্গের” কার্যক্রম চালু রয়েছে। ১৯৯৩ সালের ১০ আগষ্ট শিল্পী নিজ উদ্যোগে চিত্রাংকন, নৃত্য ও সঙ্গীত শিক্ষার জন্য ‘লাল বাউল সম্প্রদায়’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন।
এটির কার্যক্রম চালু রয়েছে। শিল্পীর শেষ জীবনে শিশুদের জন্য তৈরী করেন ভ্রমন তরী “বজরা”। তাঁর আশা ছিলো শিশুরা এই বজরায় করে বাড়ির পাশে চিত্রা নদীতে ভ্রমন করবেন এবং প্রকৃতির ছবি আঁকবেন। তিনি বলতেন, ‘শিশুরা প্রকৃতির ছবি আঁকলে তারা
কখনও মন্দ হতে পারে না’। কয়েকবার তিনি শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে বজরায় করে বেড়িয়েও ছিলেন। ২০০৩ সালে শহরের কুড়িগ্রামে সরকার শিল্পীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ‘সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা’ গড়ে তোলে। এখানেই বরেণ্য এই শিল্পীকে সমাহিত করা হয়েছে। যাযাবরের মতো জীবন-যাপন করা এই শিল্পী অসংখ্য ছবি আঁকলেও অধিকাংশ ছবিই নষ্ট এবং হাতছাড়া হয়ে গেছে। বর্তমানে নড়াইলের সুলতান কমপ্লেক্সে তাঁর আঁকা ২২টি ছবি রয়েছে। ২০০৯ সালে শিল্পীর বাগান বাড়ি শহরের পশ্চিম মাছিমদিয়ায় ‘এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
শিল্পী সুলতান এদেশের মাটি, সাধারন মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, প্রকৃতি এসব নিয়ে ছবি এঁকেছেন। তিনি এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিককে পেশীবহুল ও শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সুলতান জানতেন, এই কৃষকই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা কখনও দূর্বল হতে পারে না। গুণী এই শিল্পী শুধু চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেননি, এর পাশাপাশি বাঙ্গালির মনন ও মানবিকতা বিকাশে, শিক্ষার
বিকাশে, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারতেন। কথিত রয়েছে বিষধর সাপও তাঁর বাঁশির সুর শুনে মাথা নাড়াত। বরেণ্য এই শিল্পী ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া
১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা এবং ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শিল্পী সুলতান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সীমিত আয়োজনে পালিত হলো বরেণ্য চিত্রশিল্পী সুলতানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী

আরো পড়ুন






