Saturday, December 6, 2025

যশোরের দুই আইনজীবীর বিরুদ্ধে বার কাউন্সিলে ট্রাইব্যুনাল গঠন, এক সহকারীকে শোকজ

যশোর আদালত চত্বরে টাউট-বাটপারদের দৌরাত্ম ফের বাড়তে শুরু করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এরা ভুয়া পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর বাইরেও কার্ডধারী আইনজীবী কিংবা আইনজীবী সহকারীরাও থেমে নেই। সম্প্র্রতি আইনি সহয়তার নামে মক্কেলের জমি হজমের অভিযোগ উঠেছে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির দু’ সদস্যের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে বার কাউন্সিলে তাদের বিরুদ্ধে ট্র্যাইব্যুনালও গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি আরেক আইনজীবী সহকারীকে মক্কেলের কাছ থেকে টাকা হাতানোর অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এসব টাউট-বাটপার কিংবা দুর্নীতির সাথে যুক্ত কিছু আইনজীবী, শিক্ষানবীশ আইনজীবী এবং আইনজীবী সহকারীদের প্রশ্রয়দাতা সমিতির কয়েকজন সিনিয়র সদস্য। দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে এসব সিনিয়র সদস্য তা ধামাচাপা দিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। যদিও যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত কমিটির নেতৃবৃন্দ বলছেন, আদালত চত্বরে টাউট-বাটপারদের ঘোরাঘুরির সময় শেষ।
যশোর জেলা আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা যায়, সমিতির নিয়মিত সদস্য মনিরুজ্জামান ও তার ভাই কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে যশোরের বসুন্দিয়ার তালুকদার ইউপিভিসি কোম্পানির কর্মকর্তা সামসুল আরিফিন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে অভিযোগ দায়ের করেছেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি ডেপুটি বার কাউন্সিলর আফজাল উর রহমান ট্রাইবুন্যাল গঠন করেন। পরে ওই দু’ আইনজীবীকে নোটিস করা হয়। যার অনুলিপি যশোর জেলা আইনজীবী সমিতিতেও পাঠানো হয়। যাতে গত ২৭ জানুয়ারি শুনানির জন্য ওই দু’ আইনজীবীকে ট্রাইবুন্যালে হাজিরের জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সমিতির সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক শাহানুর আলম শাহীন।
এদিকে, জেলা আইনজীবী সমিতির অপর একটি সূত্র জানায়, রাজারহাট মোড় এলাকার তালুকদার গ্রুপের একটি জমি রয়েছে। ওই জমি নিয়ে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের দ্বারস্থ হন আরিফিন। এরপর বিভিন্ন কৌশলে ওই জমি দু’ আইনজীবী আত্মসাৎ করেন।
এসব বিষয়ে গ্রামের কাগজের অনুসন্ধানে উঠে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির নতুন সদস্য কামরুজ্জামান। তিনি আবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতিরও সদস্য। গত ডিসেম্বেরের শেষের দিকে জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী কমিটির সম্মতি ছাড়াই তিনি সদস্যপদ লাভ করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যরা অন্য কোনো সমিতিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। কিন্তু, সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাকে গভীর রাতে সদস্য পদ দেন। যা নিয়ে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত আরেক আইনজীবী মনিরুজ্জামান যশোর বারের সদস্য হয়েছেন ২০১৩ সালের ৫ মে। যশোর বারের বিধি অনুযায়ী সমিতির কোনো সদস্য অন্য কোনো পেশায় নিযুক্ত হতে পারবেন না। কিন্তু, তিনি প্রাইম ব্যাংকের বেতনভুক্ত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ব্যাংকের লিগ্যাল শাখার দক্ষিণাঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রাইম ব্যাংক যশোর শাখা ব্যবস্থাপক আব্দুর রাফি নিজে।
আব্দুর রাফি আরও জানান, আইনজীবী মনিরুজ্জামান যশোর অফিসেও কাজ করেন। শুধু মনিরুজ্জামানই নন, আরও অনেক আইনজীবী রয়েছেন যারা একইসাথে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেও জেলা আইনজীবী সমিতির সকল সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির অপর একটি সূত্র জানায়, শার্শা উপজেলার কালিয়ানী গ্রামের কিতাব আলীর ছেলে আসাদুর রহমানের বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে একটি মামলা হয়। পরে তিনি আইনজীবী সহকারী সুজলপুরের রফিক মহুরীর ছেলে নাজমুল হোসেন বিপুলের দারস্থ হন। দায়ের করা মামলায় আদালত ৫০ হাজার টাকা ডিক্রি প্রদান করেন। আসাদুর গত বছরের ১৫ মার্চ আদালতকে ৫০ হাজার টাকা প্রদানের জন্য বিপুলকে দেন। কিন্তু বিপুল আদালতে টাকা জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। এরপর আদালত টাকা না পেয়ে আসাদুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। টাকা ফেরত না পেয়ে আসাদুর সমিতিতে অভিযোগ করেন। সমিতি বিপুলকে সোমবার শোকজ করে।
আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, আদালত প্রাঙ্গনে পরিচয় দিয়ে লোক ঠকাচ্ছে আইনজীবী, সাংবাদিক আবার কখনো আইনজীবী সহকারী পরিচয়ধারী টাউট ইদ্রিস আলম। গত তিনদিন আগে তার এক সহযোগী তানিয়া পুলিশের হাতে আটক হয়। দু’ শিক্ষানবিশ আইনজীবীর বিরুদ্ধে যশোর আদালতে গত বছর মামলা ও ইদ্রিসের নানা প্রতারণার এক পর্যায়ে সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয় এ তিনজনকে সনদ প্রত্যাহারের জন্য বার কাউন্সিলে আবেদন করা হবে। কিন্তু সমিতির তৎকালীন এক কর্মকর্তা সে সিদ্ধান্ত ধামাচাপা দিয়ে ইদ্রিসসহ অন্যদের প্রতারণার সুযোগ করে দেন। বর্তমানে ইদ্রিস আদালতে না গেলেও সমিতির তিনতলার সাত নম্বর কক্ষে সকাল-সন্ধ্যা আড্ডায় মগ্ন থাকছেন।
এছাড়া, গত বছরের শেষের দিকে মনির নামে আর এক আইনজীবী সহকারীর স্থায়ী বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে দেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু আইনজীবী সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্যদের চাপের মুখে কয়েক দিনের মাথায় সে প্রত্যাহার আদেশও প্রত্যাহার করে নেন।
আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই এসব দুর্নীতিবাজদের লাগাম টানতে হবে। অন্যথায় এর ফল ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এ বিষয়ে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সহসভাপতি ও টাউট উচ্ছেদ কমিটির আহ্বায়ক খোন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন মুকুল বলেন, তিনি গত টার্মেও এ দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেও দুর্নীতিবাজ কয়েকজনকে রুখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য তিনি সমিতির তৎকালীন কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়ী করেন। তবে তিনি আদালত চত্বরে কয়েকদিন নিয়মিত তদারকি করছেন। দ্রুতই পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় এসব টাউট উচ্ছেদে নামবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন অ্যাডভোকেট মুকুল।
যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে টাউট উচ্ছেদের প্রতিশ্রুত দেয়া আছে। এটা রক্ষায় দ্রুতই টাউট উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হবে। এক্ষেত্রে, অভিযুক্ত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

বিশেষ প্রতিনিধি

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর