যশোরে গরু চোর চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মালিকদের আটকে রেখে রাতের আঁধারে নিয়ে যাচ্ছে তাদের গরু। আবার কখনো অজ্ঞান করে দিনেদুপুরে গরু চুরি করছে চোরেরা। গোটা জেলা জুড়ে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
সরেজমিন জানাগেছে, যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর গ্রামে এক রাতেই পাশাপাশি দু’ বাড়ির পাঁচটি গরু চুরি হয়েছে। গত শনিবার সতীঘাটা থেকে একরাতে পাঁচটি গরু চুরি করে নিয়ে গেছে চোরেরা। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি মণিরামপুরে একটি পরিবারের নয়জন সদস্যকে অজ্ঞান করে গরু চুরি করে নেয়ার ঘটনা ঘটে। জেলা জুড়ে যেন গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে,গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় চোরেরা দেয়ালে লিখে যাচ্ছে ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’। চুরি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে গরুর মালিকদের। ইতিমধ্যে দু’ এক জায়গায় গরু চোর ধরেছে স্থানীয়রা। গরু চোর গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, এ অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে চোখেপড়ার মতো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছেনা। এখনই গরু চুরি ঠেকাতে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জনিয়েছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ।সদর উপজেলার সতীঘাটার তোলাগোলদারপাড়ায় গত শনিবার গোয়াল ঘরের তালা কেটে আলমগীরের পাঁচটি গরু নিয়ে গেছে চোরেরা। চুরি হওয়া গরুর আনুমানিক মূল্য সাড়ে তিন লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন আলমগীর। এর আগেও তার বাড়ি থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। কয়েকদিনের ব্যবধানে একই গ্রামের আব্দুস সাত্তারের গোয়াল ঘর থেকে গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে। সোমবার হাশিমপুর এলাকায় গিয়ে কথা হয় স্থানীয় লোকজনের সাথে। তারা জানান, গত দেড় মাসের ব্যবধানে ওই গ্রাম থেকে ১১ টি গরু চুরি হয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।গত ১৮ জানুয়ারি হাশিমপুর গ্রামের মকবুলের ঘরে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় চোরেরা। ওইসময় গোয়ালে থাকা তিনটি গরু নিয়ে যায় তারা। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর রাতে একই গ্রামের মুনির হাসান খোকনের দু’টি বড় গরু ও একটি বাছুর চুরি হয়। কিছদূর যাওয়ার পর বাছুরটি ছুটে চলে যায়। এ কারণে বাছুর উদ্ধার হলেও বড় গরু দু’টির সন্ধান মেলেনি। ওই রাতেই একই এলাকার রেজাউল তরফদারের বাড়ি থেকে আরও তিনটি গরু চুরি হয়। স্থানীয়রা জানান, দেড় মাস আগে ইমাম শহিদের দু’টি চুরি হয়। একই সময় ওই গ্রামের প্রতিবন্ধী জিল্লুর একটি হালের বলদ চুরি হয়। একমাত্র অবলম্বন গরুটি হারিয়ে তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই গরুটির সাথে অপর একজনের আরেকটি গরু নিয়ে হাল চাষ করে সংসার চলতো তার। হাশিমপুর এলাকার লোকজন জানিয়েছে, স্থানীয় একটি মহলের ছত্রছায়ায় থাকা একটি চক্রের হাত রয়েছে গরু চুরির পেছনে।যদিও এ বিষয়ে ইছালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই মিজানুর রহমান বলেন, গরু চুরির ঘটনাটি তারা গুরুত্বের সাথে দেখছেন। হাশিমপুরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজনের সহায়তায় রাতে টহল দেয়ার জন্য টিম গঠন করা হয়েছে।গত ২১ জানুয়ারি বাঘারপাড়া উপজেলার গরিবপুর গ্রামের কুলছুম খাতুনের ৬৫ হাজার টাকা দামের একটি গরু চুরি হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও গরু উদ্ধার কিংবা চোর শনাক্ত হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারি মণিরামপুরের মুন্সিখানপুর ঘোষপাড়ার মৃণাল কান্তির পরিবারের সকল সদস্যকে অচেতন করে গরু চুরির ঘটনা ঘটে। ওই চুরির ঘটনায় জনতা তিনজনকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। গত বছরের ২৮ নভেম্বর সদর উপজেলার মালঞ্চী গ্রামের শহিদুল ইসলামের বাড়ি থেকে চারটি গরু চুরি হয়। এ ঘটনায় মামলা হয় থানায়। চলতি বছরের গত ২২ জানুয়ারি ঝিকরগাছা উপজেলার চন্দ্রপুরে গরু চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয় এক চোর। নিহতের নাম ইলিয়াস। সে ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগর গ্রামের ফজলু মিস্ত্রির ছেলে। ওই ঘটনায় মল্লিকপুর গ্রামের কালু মিয়ার ছেলে আব্দুল্লাহ ওরফে আবুল গুরুতর আহত হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কেশবপুর উপজেলার ভান্ডারখেলা গ্রামে নছিমনে করে আতিয়ার রহমানের বাড়িতে গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার লোকজন তাদের ধাওয়া করে। ওই সময় আনিস নাঈম নামের এক চোর গণপিটুনিতে নিহত হয়। আতিয়ার রহমানের গোয়ালে চোরেরা লিখে যায়, ‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’।
২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি সদর উপজেলার গাইদগাছি গ্রাম থেকে চোরেরা পিকআপে করে গরু চুরি করে পালাবার সময় অভয়নগরের প্রেমবাগ গ্রামে গণপিটুনিতে নিহত হয় তিন চোর। এ সময় আটক করা হয় জনি শেখ নামে একজনকে। তারাও যাওয়ার সময় গোয়াল ঘরে লিখে যায়,‘গোয়াল আপনার, গরু আমাদের’।বাঘারপাড়ার বেতালপাড়া গ্রামের মুক্তার মোল্লার বাড়ি থেকে চুরি হয় লাখ টাকা দামের একটি গরু। চুরি হয় সদর উপজেলার ডুমদিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামানের চারটি গরু। যার বাজারমূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা। একই গ্রামের শাহিনের বাড়ি থেকেও দু’টি গরু চুরি হয়েছে। বর্তমানে যশোরে গরু চোর সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করেছে।
এ বিষয়ে পুলিশসুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, গরু চোর চক্রের বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে রিমান্ডে নিয়ে। অনেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। কয়েকজন অন্যান্য জড়িতদের নামও বলেছে। পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান পুলিশসুপার।সর্বশেষ, মঙ্গলবার সদর উপজেলার মালঞ্চী গ্রামের শহিদুল ইসলামের চারটি গরু চুরির ঘটনায় ময়মনসিংহ জেলার লবণকোটা গ্রামের দুদু মিয়ার ছেলে হামিদুল ওরফে হামিদ ও গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার বাবু মোল্লার ছেলে আশিকুর রহমান বাপ্পীর দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুদ্দীন হোসাইন এ আদেশ দেন।
যশোরে গরুচোর চক্র বেপোরোয়া, ‘গোয়াল আপনার গরু আমাদের’ লিখে চোরের চিরকুট!
বিশেষ প্রতিনিধি

আরো পড়ুন






