শোকে যেন স্তব্ধ গোটা পরিবার।প্রতিবেশীরাও আসছেন; সবার চোখে জল।যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার এগারোখান অঞ্চলের দোগাছি (দাড়িরপার) গ্রামের মুকুল বিশ্বাসের বাড়িতে এখনো চলছে শোকের মাতম। দু’হাত দিয়ে ছেলের ছবি বুকে চেপে শুয়ে আছেন সন্তানহারা মা। কেঁদে চলেছেন ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদা। ছোটবোন সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দাদা দাদা বলে বিলাপ করছে।
এ রকমই এক পরিবেশ দেখা গেছে গ্রামের মুকুল বিশ্বাসের বাড়িতে। গত শনিবার এ বাড়ির ছেলে কলেজপড়ুয়া শিমুল বিশ্বাসের মৃতদেহ রঘুরামপুরের বেজিঘেড়ে বিলের কাটাখাল থেকে উদ্ধার করা হয়।
শিমুলের ঠাকুরদাদা দিলিপ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার দু’ ছেলেমেয়ে। অর্থাভাবে তাদের লেখাপড়া শেখাতে পারিনি। নিজের সামান্য জমি আর বর্গাচাষ করেই সংসার চলতো। সবাই কঠোর পরিশ্রম করে একটা আধাপাকা ঘর করেছি। পরিবারের স্বপ্ন, মুকুলের ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করা। তারা চাকরি করে ঘুচাবে আর্থিক দৈন্য।’
শিমুল বাকড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এ প্লাস পেয়ে ভাঙ্গুড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে (বিজ্ঞান) ভর্তি হয়। পিএসসি-জেএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। মেয়ে শিবাজী কমলাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মহামারি করোনার কারণে কলেজ বন্ধ। তাই এলাকার বিভিন্ন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তো। কারও সাথে আড্ডা দিত না। প্রাইভেট আর বাবার সাথে মাঠে কাজ করা-এটাই ছিল তার জগৎ। এমনকী কারও সাথে ঝগড়া করার কথাও কেউ বলতে পারবে না। এমন নিরীহ ছেলেকে কেউ মেরে ফেলতে পারে… বলতে বলতে হাউ-মাউ করে কেঁদে ফেলেন এই ৮০ বছরের বৃদ্ধ।
বলতে থাকেন তিনি, ‘যতদিন দোষীরা ফাঁসিতে না ঝুলবে, ততদিন এ মামলা লড়ে যাবো। আমার সর্বস্ব বিক্রি করতে হলেও করবো। কার জন্য আর অর্থ-সম্পদ জমাবো?’
শিমুলের ঠাকুরমা রমলা বিশ্বাস জানান, শিমুলের মায়ের বুদ্ধি একটু কম। ওদের দু’ভাইবোনকে আমরা বুড়ো-বুড়ি মিলে বড় করেছি। আমাদের কাছেই তাদের যত আবদার। ঠাকুরদাদার সাথে প্রতিদিন চা খেতে যাওয়া, আর রাত হলে নাতনিটা আমার কাছে আর নাতি তার ঠাকুরদার কাছে ঘুমায়। দিনগুলো এভাবে যাচ্ছিল। কত স্বপ্ন ছিল শিমুলের-বড় হয়ে ছোটকাকুর (ভারতের উত্তর প্রদেশের চাঁদশী ডাক্তার) মত ডাক্তার হবে। এমবিবিএস পাস করে এলাকার রোগীদের চিকিৎসা দেবে। তাই কাকুকে দেখতে পাসপোর্টও তৈরি করে সে। কিন্তু করোনার কারণে ভিসা হয়নি। শিমুলের পাসপোর্ট বুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সব কিছু শেষ করে দিল শয়তানরা।’
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে ঠাকুরদাদা বলেন, ‘গত ১৬ জনুয়ারি শনিবার ঘোড়ানাছ গ্রামের মুকুল ভৌমিকের বাড়িতে ছিল তার ছেলের বৌভাত। সেখানে পরিবারের সবার নিমন্ত্রণ। সবাই গেলেও আমি শীতের কারণে যেতে পারিনি। কথা ছিল, শিমুল নিজে খেয়ে আমার জন্যও খাবার নিয়ে আসবে। সন্ধ্যায় যথারীতি খাবারও নিয়ে আসে। শিমুল এসে বলে, ছোটবোন রঘুরামপুরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। আমি ওকে (শিবাজী) নিয়ে আসি। বলেই রাত সাড়ে সাতটার দিকে দুটো ফোন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু নাতনি ফিরে এলেও শিমুল আর ফেরেনি। ও মাঝে-মাঝে ঘোড়ানাছের মুকুলের বাড়িতে রাত কাটায়, সেটাই সবাই অনুমান করি। পরের দিন (রোববার) শিমুলের প্রইভেট পড়া বাদ যাচ্ছে ভেবে খুঁজতে বের হই এলাকার তে-মাথায় (দোগাছি, ঘোড়ানাছ ও কমলাপুর রাস্তার ত্রিমোহনা)। যেখানে শিমুল যায়, সব জায়গা খুঁজেও ওকে পাইনি। বেলা দু’টো নাগাদ খবর পাই, আদরের শিমুলের মৃতদেহ কাটাখাল থেকে উদ্ধার করে ভ্যানে করে যশোর নিয়ে যাচ্ছে।’
ওর সুন্দর চেহারা ছিল। মরদেহ বিকৃত হওয়ায় প্রথমদিকে এলাকার কেউ চিনতে না পারলে ‘অজ্ঞাত’ বলেছিল পুলিশ।
বাকড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতিষ ঢালি বলেন, ‘শিমুলের মত নম্র ভদ্র বিনয়ী সর্বোপরি এমন মেধাবী ছাত্র আমার শিক্ষকতা জীবনে পাইনি। তার এই খুন হওয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’ প্রতিবেশী সুকুমার বিশ্বাস বলেন, শিমুলের মতো মেধাবী ও ভদ্র ছেলে আমাদের পাড়ায় নেই। তার খুনিদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’
বেলা তিনটার দিকে বাড়ি পৌঁছায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এরপর হাতিয়াড়া গ্রামের শ্মশানে সমাহিত করা হয় সবার প্রিয় শিমুলকে।
বাঘারপাড়া থানা সূত্রে জানা গেছে, সন্তানহারা বাবা দিলীপ বিশ্বাস পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। অভিযুক্তরা হলেন দোগাছি গ্রামের নিমাই গোলদারের বড়ছেলে সৌমিত্র গোলদার, ছোটছেলে অমিত গোলদার, পাগল গোলদারের ছেলে লক্ষিকান্ত গোলদার, শক্তিপদ গোলদারের জামত্ কৃষ্ণ বিশ্বাস ও জগা ফকিরের ছেলে কৃষ্ণপদ বিশ্বাস।
পুলিশ রোববার রাতেই এ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে পরদিন আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করে।
বিশেষ প্রতিনিধি







