আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উত্তপ্ত ও প্রাণচঞ্চল। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছে— সব প্রস্তুতি শেষ, এখন শুধু জনগণের অংশগ্রহণের অপেক্ষা।
রাজধানী থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচনি কাঠামো প্রস্তুত। ইসির ভাষায়, ভোটের সব আয়োজন সম্পন্ন, এখন সময় ভোটারদের আস্থা পরীক্ষার।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রাথমিক সময়সূচি নির্ধারিত। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, আসন সীমানা পুনর্বিন্যাস, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও আইনগত সংশোধনসহ প্রায় সব প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ পর্যায়ে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমরা একটি উৎসবমুখর, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। এজন্য প্রশাসনিক, প্রযুক্তিগত বা আইনগত কোনো ঘাটতি যেন না থাকে, সেটিই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, ভোটার তালিকা ও কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার শতভাগ হালনাগাদ করা হয়েছে। এ বছর নতুন ভোটার হয়েছেন প্রায় ২৫ লাখ, যার মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী।
ইসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে মোট ভোটার ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪১ লাখ, নারী ৬ কোটি ২২ লাখ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩০ জন। সারাদেশে ভোটের জন্য ৪২ হাজার ৭৬১টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি ভোটকক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আমাদের প্রস্তুতি ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ শেষ। রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত হলেই আমরা শতভাগ প্রস্তুত।
তিনি আরও জানান, ইসির বিভিন্ন দায়িত্বে ১৮টি টাস্কফোর্স কাজ করছে— কেউ লজিস্টিক, কেউ আইটি, কেউ নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান করছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও আচরণবিধির সংশোধনে এসেছে বেশ কিছু নতুন দিক। পুনর্বহাল হয়েছে ‘না ভোট’। ইভিএম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা বাতিল। প্রার্থীর সম্পদ, আয় ও করের তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক। অনুদান গ্রহণে ব্যাংকিং চ্যানেল বাধ্যতামূলক। পলাতক আসামিদের প্রার্থিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নির্বাচনি জামানত ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইসি বলছে, এসব সংস্কার নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গঠিত হয়েছে একাধিক সমন্বয় কমিটি। ভোটের আগে তিন দিন, ভোটের দিন এবং ভোটের পর চার দিনসহ মোট আট দিন মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দায়িত্বে থাকবে দেড় লাখ পুলিশ, এক লাখ সেনাসদস্য এবং আনসার-ভিডিপির সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্য।
প্রথমবারের মতো তাদের জন্য বিশেষ আচরণবিধি ও প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা হয়েছে, যাতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে।
ভোটকালীন অনলাইন গুজব ও বিভ্রান্তি মোকাবিলায় ইসি গঠন করেছে ‘মিসইনফরমেশন মনিটরিং সেল’। এই সেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর প্রযুক্তিতে ভুয়া প্রচারণা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য শনাক্ত করবে। এনটিএমসি, বিটিআরসি, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আইসিটি বিভাগের সহযোগিতায় সেলটি কাজ করবে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ‘Postal Vote BD’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করছে ইসি। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত ভোটাররা ডাকযোগে ভোট দিতে পারবেন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ ১১টি দেশে এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে, আগামী বছর আরও আট দেশে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে ইসি তাদের সার্ভার ও ভোটার ডেটাবেজ আপগ্রেড করেছে। এবার প্রতিটি জেলার কন্ট্রোল রুম থেকে রিয়েল-টাইমে ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করা হবে।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আমরা এবার প্রক্রিয়াগত ব্যর্থতা শূন্যে নামাতে চাই। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের হিসাব ডিজিটালি রিপোর্ট হবে কমিশনে।
ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে গ্রামীণ পর্যায়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক প্রচারণা। রেডিও, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউনিয়ন পরিষদে চলছে সচেতনতা কার্যক্রম। নারী ও তরুণ ভোটারদের বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসি তথ্য ও প্রচার বিভাগ।
একজন কমিশন কর্মকর্তা বলেন, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরা যদি ভোটে আসে, নির্বাচনে প্রাণ ফিরে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহিতুল হক বলেন, নির্বাচনের আগে ইসির স্বচ্ছতা ও দৃঢ় মনোভাবই জনগণের আস্থা ফেরানোর প্রথম ধাপ। কমিশন যদি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব।
রাজনৈতিক অঙ্গন, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টি এখন এক জায়গায়— কেমন হয় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। ইসি বলছে, তাদের প্রস্তুতি শতভাগ সম্পন্ন, এখন সিদ্ধান্ত জনগণের হাতে।
নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের ভাষায়, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আরেকটি মাইলফলক হবে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই এবার প্রকৃত বিজয়ী হবে।
অনলাইন ডেস্ক/আর কে-০৩







