কুষ্টিয়ার কুমারখালী পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকটি ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টাব্যাপী কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের বেড় কালোয়া জেলেপাড়ার থেকে কালোয়া বাজার পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহতরা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল, কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহতরা হলেন- কুমারখালী উপজেলার বেড় কালোয়া গ্রামের আনারুলের ছেলে আকরাম হোসেন (৩১), দুলাল শেখের ছেলে রাজিব শেখ (৩২), আলম মণ্ডলের ছেলে আলামিন মণ্ডল (৩৩), বজলু শেখের ছেলে রুহুল আমীন (৫২), কুদ্দুস শেখের ছেলে আশিকুর রহমান (৩২), কেরায় শেখের ছেলে তাজিম শেখ (৫০), জেহের শেখের ছেলে কুদ্দুস শেখ (৬৫), মৃত মোশারফের ছেলে দুলাল হোসেন (৪২) ও মহির শেখের ছেলে খুতে শেখ (৩৫)। তাদেত মধ্যে আশিকুর, রুহুল আমিন ও তাজিম শেখ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাকিরা বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্বপন বাহিনী ও ইয়ারুল বাহিনীর মধ্যে বিরোধ চলছিল। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার ভোরে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তারা কুষ্টিয়া ও কুমারখালী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। স্থানীয়রা বলেন, স্বপন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিনি ও তার বাহিনীর লোকজন পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, নদীতে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইয়ারুল বাহিনী পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম শুরু করে। কয়েকদিন ধরে পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে ইলিশ মাছ শিকার করছে মাঝিরা। এসব মাঝিদের কাছে থেকে ইয়ারুল ও তার বাহিনীর লোকজন নৌকা প্রতি প্রতিদিন দুই হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করে আসছে।
এসব নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত প্রায় ৩০০ রাউন্ড গোলাগুলি হয়। বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সংঘর্ষের পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এ ঘটনায় পুরো বেড় কালোয়া এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন কুদ্দুস শেখের ছেলে আশিক শেখ বলেন, বেড় কালোয়া এলাকায় পদ্মা নদীতে প্রচুর গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীতে লাইটের আলো মারি। এ সময় দেখি দুইটা নৌকায় ১৩ জন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে একের পর এক গুলি ছুড়তে ছুড়তে কিনারার দিকে আসছে। এ সময় আমাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে ধানের ফসলের মাঠে পালিয়ে যাই। পরে তারা প্রায় ৫০ জন ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে গিয়ে বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। তারা কয়েকশো রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। এ ঘটনায় স্বপন বাহিনী রিপন, সিপন, আশরাফুল, আশিক, লিটন চোর সরাসরি জড়িত। তারা পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা পলাতক ছিল। কিছুদিন আগে থেকে হারেজ মোড়ের বকুল বালুর ঘাট নিয়ে কালোয়া মোড়ে মস্তানি করে। এতে আমরা বাধা দিই। এ জন্য আমাদের গুলি করেছে, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেছে। শতশত রাউন্ড গুলি এলোপাতাড়ি ছুড়েছে। আমরা স্বপন চেয়ারম্যান, খচ্চু, বাচ্চুর বিচার চাই। আহত তাজিম শেখ বলেন, স্বপন বাহিনীর লিটন, সিপন, খালেক মেম্বারের ছেলেরা, খচ্চু, মুকুল, বকুলসহ তাদের বাহিনীর লোকজন কয়েকশো রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। তাদের গুলিতে আমরা আহত হয়েছি। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১৭ বছর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছে, নদীতে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী অপকর্ম করেছে। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইলিশের প্রজনন মৌসুমে পদ্মায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। তবুও নদীতে অবৈধভাবে মাছ ধরা, বালু উত্তোলন ও জেলেদের কাছ চাঁদা উত্তোলন নিয়ে কয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও ইউপি সদস্য রাশিদুল ইসলাম, তার ভাগ্নে সালমান রহমান বকুল গ্রুপের সঙ্গে ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য ও সাবেক ইউপি সদস্য বকুল বিশ্বাস ও জেলেপাড়ার সরদার ইয়ারুল ইসলাম গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। তবে এ নিয়ে উভয়পক্ষের নেতাকর্মীরা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছেন।
বিএনপি নেতা বকুল বিশ্বাস ও জেলে নেতা ইয়ারুল গ্রুপের অভিযোগ, কয়া ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি রাশিদুল ইসলাম ও তার ভাগ্নে বকুল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল খালেকের ছেলে রিপন, শিপন, লিটনসহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে অতর্কিত গুলিবর্ষণ করেছে এবং বেশ কিছু বাড়িতে ভাঙচুর লুটপাট চালিয়েছে। পদ্মায় অবৈধভাবে মাছ ধরা, বালু উত্তোলন ও চাঁদাবাজি করার জন্য তারা এমন হামলা চালিয়েছে। এতে এ গ্রুপের ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আর বিএনপি নেতা রাশিদুল ইসলাম গ্রুপের অভিযোগ, বিএনপি নেতা বকুল বিশ্বাস কয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হাজীর ভাই সোহেল রানা, আওয়ামী লীগের সমর্থক ও জেলেদের নেতা ইয়ারুল ইসলামের সঙ্গে মিলেমিশে পদ্মায় মাছ, বালু লুট ও চাঁদাবাজি করার জন্য গুলি চালিয়েছে। এতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আহত বিএনপির কর্মী কুদ্দুস শেখ বলেন, ফজরের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন রাশিদুল ও বকুল আওয়ামী লীগের লোকজন সাথে করে বৃষ্টির মত গুলি করতে থাকে। দৌড়ে পালালেও আমার ডান হাতে এসে একটি গুলি লাগেছে।
কালোয়ামোড়ে ভাঙারি ব্যবসায়ী দুলাল হোসেন বলেন, ফরিদপুর থেকে রাতে বাড়ি আসছি। আর ভোরবেলায় ওরা হামলা করেছে। আমার হাতে মুখে বুকে ছরড়া গুলি ঢুকে আছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিপক্ষের আহত রাজিব শেখ বলেন, গুলির শব্দে ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে আসতেই দেখি প্রতিপক্ষের ইয়ারুল, সোহেল, রুহুল সহ অনেকেই গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। তখন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও হাতে পায়ে মুখে গুলি লেগেছে। আমরা তিনজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছি।
অভিযোগ অস্বীকার করে ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি রাশিদুল ইসলাম বলেন, কিছু দিন আগে আমার ওপর হামলা করেছিল প্রতিপক্ষের লোকজন। নদীতে চাঁদাবাজি ও লুটপাটের জন্য ইয়ারুল তার লোকজন নিয়ে গুলি করেছে। এতে আমার ৩ সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়েছে। থানায় মামলা করা হবে।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
কুমারখালী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার জিয়াউর রহমান বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়নি। কাউকে আটক করা যায়নি। এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে পুলিশ। ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
রাতদিন-অনলাইন ডেস্ক-