নেই লাইসেন্স, স্যাঁতসেতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অদক্ষ
জনবল দিয়ে চলছে প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট !!!
স্টাফ রিপোর্টার: যশোর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বেহালদশা। স্যাঁতসেতে আর নোংড়া পরিবেশ, অদক্ষ জনবল আর লাইসেন্স বিহীন এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বছরের পর বছর অবৈধ ভাবে ব্যবসা করে গেলেও তা দেখার কেউ নেই। এই অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে রীতিমতো প্রতারনায় নেমেছে। প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট, এক্সরে, ইসিজি, ইকো, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিবিসি,আরবিএস,সিরাম ক্রিটিনাইন, এমআরআই, সিটি স্ক্যান থেকে শুরু করে এহেন কোন মেডিকেল টেষ্ট নেই যা এই প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে না। কিন্তু এসবই হচ্ছে কাগজে কলমে। যার গ্রহণযোগ্যতার মান জিরো। প্রতিনিয়িত মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নানারকম প্যাথলজিক্যাল টেষ্ট্রের নামে হয়রানী আর প্রতারনার শিকার হচ্ছেন। যশোর ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনের ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে নিম্ন মানের ও মেয়াদোতীর্ণ রি-এজেন্ট দিয়ে দেদারছে এরকম প্রতারনা করলেও জেলার স্বস্থ্য বিভাগ নির্বিকার। অভিযোগ উঠেছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের বড় কর্তাকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে দিব্যি জেলার সব অবৈধ ক্লিনিক ও প্যাথলজিক্যাল সেন্টার মানুষ ঠকানোর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্যথলজিতে ব্যবহার্য বর্জ ফেলা হচ্ছে পাশের ভৈরব নদে। যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্নক ক্ষতির কারন হচ্ছে ।
৮ জন শেয়ার হোল্ডারকে নিয়ে ২০১৪ সালে স্বল্প পরিসরে ব্যবসা শুরু করে যশোর ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি। পর্যায়ক্রমে পরিসর বৃদ্ধি পায়। গোলাম সরোয়ার নামে একজন ব্যবসায়ী উদ্যোগ নিয়ে এই সেন্টারটি শুরু করেন। সে সময় ডাঃ মোজাম্মেল হককে চেয়ারম্যান এবং গোলাম সরোয়ারকে এমডি করে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। বাকি শেয়ার হোল্ডারগণ ছিলেন নাসিমা সুলতানা স্বপন,ডাঃ ফারজানা আজাদ, নাসরিন সুলনানা রিনা, খোদেজা জাহাঙ্গীর, সাইদুর রহমান, সারমিন আক্তার ফারুক ও মাসুদ পারভেজ। শুরুতে প্রতিটি শেয়ারের মুল্য ৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে তা কয়েক দফা বাড়িয়ে ৫ লাখ ২০ হাজার করা হয়। পরবর্তীতে আরো কয়েক দফা শেয়ার বৃদ্ধি করে তা বিক্রির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব শেয়ার হোল্ডারদের অর্থ দিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির কোন জয়েন স্ট্রক কোম্পানীর লাইসেন্স নেই। কেবলমাত্র যশোর পৌরসভা থেকে যশোর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স নং-০১৪৮৫ নিয়ে প্যাথলজিক্যাল টেষ্টের ব্যবসা শুরু করেন। পর্যাক্রমে প্রয়োজনীয় অন্যান্য লাইসেন্স সংগ্রহ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই সব লাইসেন্স আর নবায়ন করা হয়নি। রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বছরের পর বছর এই প্রতিষ্ঠানটি কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছা মতো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে,জুলাই বিপ্লবে পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হলে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা মঞ্জুর রশীদ স্বপন পালিয়ে যান। প্রতিষ্ঠানের এমডি গোলাম সরোয়ারও গা ঢাকা দেন। এক পর্যায়ে একটি শেয়ারের ৫০ শতাংশের মালিকানার অধিকার নিয়ে যশোর ২৫০ শষ্যা জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার ও ড্যাব নেতা অহিদুজ্জামান আজাদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোর ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বর্তমানে চলছে হাওয়ার ওপর। বর্তমানে এই সেন্টারটির কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। ফায়ারের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হেলথ লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ৩০ জুন। ২০২৩ সালের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কোন আয়কর রিটার্ণ দাখিল করেনি ।বাংলাদেশ পরমানু শক্তি নিয়ন্ত্রন কমিশনের অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালে। নেই কোন আরসিও লাইসেন্স প্রাপ্ত রেডিওলিষ্ট। নেই কোন লাইসেন্স ধারী পাস করা প্যাথলজিষ্ট। নেই কোন বৈধ লাইসেন্সধারী সনোলজিষ্ট। নেই কোন পাস করা ডিগ্রিধারী প্যাথলজিক্যাল স্টাফ। একজন অদক্ষ কোয়াক স্টাফ দিয়ে রোগীদের শরীর থেকে ব্লাডের সেম্পল কালেকশন করা হচ্ছে। নেই কোন সিটিজেন চার্টার। ইচ্ছা মতো রোগীদের কাছ থেকে টেষ্টের নামে অর্থ আদায় করা হচ্ছে বলেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কিন্তু এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। এক অজানা ক্ষমতার বলে বলিয়ান ডাক্তার অহিদুজ্জামান আজাদ এসব অনিয়ম আর দূর্নীতিকে নিয়মে পরিণত করে দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছেন যশোর ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি। অভিযোগ রয়েছে একাধিক দালাল আর কমিশন ভোগী গ্রাম্য কোয়াক ডাক্তারের মাধ্যমে রোগীদের জোগাড় করা হয়। যশোর সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে এসব দালালরা সক্রিয় থাকে রোগী কালেকশনে। তার পর নানা কৌশলে রোগীদের এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আসার পর শুরু হয় নানা রকমের ব্যবসা আর অর্থ আয় করার কলাকৌশল। গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে এই প্রতিবেদক ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিতে গেলে চোখে পড়ে সর্বত্রই অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নহীনতার ছাপ। ক্লিনিকের সব ময়লা অবর্জনা ফেলা হচ্ছে পাশেই ভৈরব নদে। স্যাঁতসেতে পরিবেশে গাদাগাতি করে বসে আছেন রোগী আর দালালরা। রিসিপশনের পাশে একটি ছোট্ট টেবিল চেয়ার নিয়ে বসে আছেন ম্যানেজার ফারুক হোসেন। সাংবাদিক পরিচয় শুনেই তিনি তেলেবেগুনে জ¦লে ওঠেন। এক পর্যায়ে তিনি কোন তথ্য না দিয়েই মুখটি ঘুরিয়ে নেন। পাল্টা প্রশ্ন করলে তিনি জোর গলায় বলেন, সাংঘাতিকদের আমরা চিনি। যান আমাদের চেয়ারম্যান ডাক্তার অহিদুজ্জামান আজাদের সাথে কথা বলেন। আমি কোন তথ্য দিতে আপনার কাছে বাধ্য নই।
এ বিষয়ে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেয়ারম্যান ডাঃ অহিদুজ্জামান আজাদ বলেন, আমি তো যশোর আড়াইশ’ বেড হাসপাতালে রোগী দেখছি। কোন কথা থাকলে হাসপাতালের ডক্টরস রুমে আসেন। এক পর্যায়ে ক্লিনিক সম্পর্কীত নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বললে তিনি বিষয়টি নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করতে নিষেধ করেন।
এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির এমডি গোলাম সরোয়ারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমাকে তো আজাদ ও ফারুক জোর করে ক্লিনিক থেকে বের করে দিয়েছে। আমার রুমটি দখল করে নিয়েছে ডাক্তার আজাদ। গত ৭/৮ মাস আমি প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানের কোন আয় ব্যয়ের হিসাব শেয়ার হোল্ডারদের দেওয়া হচ্ছে না। ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখায় ক্লিনিকের নামে খোলা হিসাবে কোন লেনদেন না করে সব টাকা চেয়ারম্যান ডাক্তার আজাদ ব্যক্তিগত ভাবে হজম করছে। তিনি বলেন এই প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার আজাদের কোন শেয়ার ছিলো না। একটি শেয়ারের ৫০ শতাংশের মালিক আমার ছোট বোন আনোয়ারা নাসরিন আর বাকি ৫০ শতাংশের মালিক ডাক্তার আজাদের স্ত্রী ডাঃ ফারজানা পারভীন। অথচ জুলাই বিপ্লবের পর রাতারাতি ডাক্তার আজাদ ম্যানেজার ফারুক হোসেনের সাথে হাত মিলিয়ে ক্লিনিকটি দখল করে নিয়ে চেয়ারম্যান বনে গেছেন।
ক্লিনিকের অপর শেয়ার হোল্ডার খোদেজা পারভিনের স্বামী ও পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার স্ত্রী একজন শেয়ার হোল্ডার।তার কারনে আমি ক্লিনিকের একজন ডাইরেক্টর। কিন্তু গত প্রায় ১ বছর ধরে আমি ওই ক্লিনিকে যাই না। সেখানে যাওয়ার কোন পরিবেশ নেই। আমার ছোট ভাই ফারুক ডাক্তার আজাদের সাথে মিলে পুরো ক্লিনিকটি ধ্বংসের চক্রান্তে মেতেছে। আয় ব্যয়ের কোন হিসাব নেই। শেয়ার হোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ব্যাংক হিসাবে কোন টাকা জমা পড়ছে না। সব আয় ইনকাম ক্লিনিকের চেয়ারম্যান ডাক্তার আজাদ আর ম্যানেজার ফারুক ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে। আমার বড় ভাই ক্লিনিকের এমডি গোলাম সরোয়ারকে পর্যন্ত এমডির পদ থেকে সম্পূর্ণ অগনতান্ত্রিক ও নিয়মবর্হিভূত ভাবে অপসারন করা হয়েছে। অন্যান্য শেয়ার হোল্ডারদের সেখানে কোন স্থান নেই। ক্লিনিকের লাইসেন্সসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও অদক্ষজনবল সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এসবই চেয়ারম্যান, এমডি আর ম্যানেজারের দেখার বিষয়। আমরা শেয়ার হোল্ডারগণ এসব বিষয়ে কিছুই জানিনা।
যশোর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বর্জ ব্যবস্থাপনার সরকারী নিয়ম কানুন অগ্রাহ্য করা প্রসঙ্গে জেলার সিভিল সার্জন ডাক্তার মাসুদুর রহমানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এই সব অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে আপনারা লেখেন। আমাকে তথ্য দেন। জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বলেন। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এসব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্ট্রারের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।আমার তো পুলিশ নেই, ম্যাজিষ্ট্রেট নেই। ডিসি স্যার যদি উদ্যোগ নেন তাহলে জেলার সর্বত্র ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সব বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব । লাইসেন্স বিহীন মানহীন এসব অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার এতো দিন কিভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, কিভাবে মানুষের সাথে প্রতারনা করে তাদেরকে পরীক্ষা নিরীক্ষার নামে প্রতারনা করে অর্থ বানিজ্য করছে-? এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি তো অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় অবস্থান করছি। যশোরে এসে এসব বিষয় গুলো দেখবো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যশোর ড্যাবের একজন নেতা বলেন, একজন ডাক্তার সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় কিভাবে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের চেয়ারম্যান হতে পারে! এটা তো সরকারী চাকুরীবিধির চরম লংঘন। সিভিল সার্জন সব জেনেও কেন এবং কি কারনে এসব অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না তা রহস্যজনক।