দেশে আন্তর্জাতিক মানের নিজস্ব চামড়াজাত ব্র্যান্ডের অভাব দূর করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালে “ওয়াইল্ড ওভেন” গড়ে তোলেন দুই তরুণ উদ্যোক্তা এনামুল হক ও ফয়সাল ইসলাম। প্রতিষ্ঠার ছয় বছর না পেরোতেই মানিব্যাগ, বেল্ট, ব্যাগ, ল্যাপটপ কাভার, চাবির রিং ও জ্যাকেটসহ নানা ফ্যাশন উপকরণ দেশ-বিদেশে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় পৌঁছেছে প্রায় সাত কোটি টাকায়।
উদ্যোক্তাদের পথচলা শুরু ২০১৪ সালে, যখন তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তেন। এনামুল হক এক কারখানায় আড়াই বছর কাজ করে চামড়াজাত পণ্য তৈরির কৌশল শেখেন। পরে ঢাকার বাড্ডায় ২০০ বর্গফুট জায়গায় মাত্র দুই লাখ টাকা, তিনটি সেলাই মেশিন ও একজন কারিগর নিয়ে তাদের কারখানা চালু হয়। বর্তমানে কারখানার আয়তন প্রায় তিন হাজার বর্গফুট এবং কর্মীর সংখ্যা ৭০।
ব্যবসার শুরুতে পরিচিতদের ছোট ছোট ক্রয়াদেশে কাজ এগোয়। বিদেশি অংশীদারদের সহায়তায় দক্ষিণ আফ্রিকার এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০০টি মানিব্যাগের প্রথম উল্লেখযোগ্য অর্ডার পান তারা; কাজের গুণে ওই ক্রেতা টানা দুই-আড়াই বছর অর্ডার দেন। এখন “ওয়াইল্ড ওভেন লেদার প্রোডাক্টস” ও “ওয়াইল্ড ওভেন”—দুটি নামে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
করোনা মহামারিতে ২০২০ সালে কার্যক্রম বড় ধাক্কা খেলেও অনলাইনে বিক্রি জোরদার করে “ওয়াইল্ড ওভেন” দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। ছয় মাস ধরে প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে একটি করে কেএন৯৫ মাস্ক উপহার দেওয়ায় লাভ কমলেও ক্রেতার আস্থা বাড়ে। প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল পরিবেশবান্ধব কারখানা থেকে সংগ্রহ করে এবং পণ্য তৈরির প্রতিটি ধাপে টেকসই প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়।
বর্তমানে তাদের তৈরি পণ্যের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি হয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়াসহ ৯টি দেশে রপ্তানির পাশাপাশি দেশে করপোরেট ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্যও পণ্য সরবরাহ করে “ওয়াইল্ড ওভেন লেদার প্রোডাক্টস”। বিদেশি ব্র্যান্ডের মধ্যে মুরা, সিকার, জে এস ডিজাইন, নো স্ট্যান্ডিং হেয়ার ও আটলান্টা এবং দেশীয়ভাবে সেইলর, আড়ং, লা রিভ, আর্টিসান, এমআইবি স্পিরিট, ইয়োলোসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের ক্রেতা। এইচএসবিসি, ইউসিবি, সিটি ব্যাংক, অপসোনিন ফার্মা, গ্রামীণফোন, অ্যারিস্টোফার্মা ও জেটিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানেও সরবরাহ করে। ব্র্যান্ডভিত্তিক বিক্রিতে বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে “ওয়াইল্ড ওভেন”; অনলাইনে পণ্যের দাম ৩৫০ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। এখন পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছেছে। ঢাকার বনানীতে “যাত্রাবিরতি” ও “স্টিচেস ক্লদিংস” নামে দুটি প্রদর্শনী কেন্দ্রে তাদের পণ্য মজুত আছে; অদূর ভবিষ্যতে নিজস্ব শোরুম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
উৎপাদন সক্ষমতা বছরে প্রায় পাঁচ লাখ বর্গফুট চামড়াজাত পণ্য। উদ্যোক্তাদের ভাষ্য, দ্রুত উৎপাদনের চেয়ে সময় ও প্রকৃতির ভারসাম্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ফয়সাল ইসলাম বলেন, “চামড়াশিল্পে নতুন মানদণ্ড তৈরি করতে শুরু থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব উপায় ব্যবহার করি।” এনামুল হক জানান, খুব শিগগিরই আট হাজার বর্গফুটের দুইতলা ভবনে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কারখানা স্থানান্তর করা হবে। পাশাপাশি শূন্য কার্বন নিঃসরণ ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে উৎপাদনজনিত কার্বন অফসেট করতে সমপরিমাণ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে।
খাতের প্রেক্ষাপটে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩৫ কোটি ডলারের চেয়ে ২ দশমিক ২১ শতাংশ কম। এমন পরিস্থিতিতেও “ওয়াইল্ড ওভেন” দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে “মেড ইন বাংলাদেশ”কে প্রতিষ্ঠিত করতে নতুন আস্থার গল্প লিখছে।







