ডুমুরিয়া প্রতিনিধি: খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শাহাপুর-মধুগ্রাম খাল। সেখানকার খালে বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে পূর্ণ থাকে। এক ফসলি জমির কারণে সেখানে কৃষকদের অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে হয়। তবে তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে ভাসমান সবজি চাষ।
লাভজনক হওয়ায় সরকারি বিভিন্ন খাল-বিলে ভাসমান খেতে বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন ভূমিহীন কৃষকেরা। ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে একদিকে যেমন পারিবারিক চাহিদা পূরণ করছেন, অন্যদিকে বাজারে বিক্রি করে বেশ আয়ও করছেন ওই কৃষকেরা। বর্তমানে এ উপজেলায় ১৫০ জন ভূমিহীন কৃষক জলাশয়ে ভাসমান খেতে সবজি চাষ করছেন।
ডুমুরিয়ার রুদাঘরা ইউনিয়নের মধুগ্রাম খালে সরেজমিনে দেখা যায়, খালের পানিতে ভাসছে সারি সারি বেড (শয্যা)। বিলের পানি ছাড়াও এই পদ্ধতিতে বাড়ির পাশে জলাশয়ে সবজি চাষ করা হচ্ছে। ভাসমান ওই শয্যায় শসা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, বেগুন, লালশাক, পুঁইশাক ও পালংশাকসহ নানা প্রকার সবজির সমারোহ। কোনোটি আবার শুধুমাত্র লালশাক। খালের পানিতে ওই দৃশ্য এক অপরূপ শোভা সৃষ্টি করেছে।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর তিনেক আগে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে ওই খালে সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেন মহসিন সরদার। পরে দিনে দিনে তা প্রসারিত হচ্ছে। এখন অনেকেই ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া পুরোটাই জৈব পদ্ধতিতে হওয়ায় সবজিগুলো দেখতেও অনেক ভালো হয়। এ কারণে বাজারে ওই সবজির চাহিদাও বেশি।
ওই খালে সবজি চাষ করছেন মধুগ্রামের বিল্লাল সরদার। তিনি একজন ভূমিহীন কৃষক। খালে রয়েছে তার ছয়টি বেড।
বিল্লাল জানান, তার চাষাবাদ করার কোনো জায়গা নেই। অন্যের জমিতে খেটেই তার সংসার চলে। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে সরকারি খালে ভাসমান বেড তৈরি করে সবজি চাষ শুরু করেছেন। ওই বেডে লাগিয়েছেন লালশাক ও লাউ। এরই মধ্যে লালশাক তুলে বাজারে বিক্রি করেছেন আর লাউ কেবল বড় হতে শুরু করেছে।
হড়হড়িয়া খালে ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা ছলিম মোড়ল বলেন, এলাকার অধিকাংশ জমিতে এক ফসল হয়। বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে। আগে অভাব-অনাটন লেগেই থাকত। পরে ভাসমান সবজি চাষ শুরু করি।
ছলিম আরো বলেন, সপ্তাহে দু‘দিন স্থানীয় হাটে সবজি নিয়ে বিক্রি করি। কখনো কখনো ব্যবসায়ীরা এসে বাড়ি থেকেই সবজি কিনে নিয়ে যান। বিষমুক্ত হওয়ায় প্রচুর চাহিদা রয়েছে এসব সবজির।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র মতে, উপজেলার মধুগ্রাম, মিকশিমিল ও রংপুর ইউনিয়নের কৃষকেরা ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। যেসব খাল ও বিল বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে পূর্ণ থাকে এবং সেখানে কোনো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না, এমন জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে সবজির বেড। এ ক্ষেত্রে ওই এলাকার কৃষকেরা স্থানীয় খাল ও বিলকে বেছে নিয়েছেন।
খালের পানিতে বেড তৈরি করতে কৃষকেরা ব্যবহার করেছেন বাঁশের চালি। তার ওপর দিয়েছেন প্রায় এক ফুট ওই বিলেরই কচুরিপানা। আর কচুরিপানার ওপর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে মাটি। দেওয়া হয়েছে সামান্য কিছু জৈব সারও। আর ওই মাটিতে চাষ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজি। প্রতিটি বেডের আয়তন লম্বায় ১৪ ফুট ও চওড়ায় সাত ফুট।
মিকশিমিল গ্রামের চাষি শেখ মাহাতাব হোসেন বলেন, এলাকার অনেককে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ করতে দেখে আমিও শুরু করি। এতে অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হয়। বর্ষার মৌসুমে মানুষের কষ্ট হয়। তবে হড়হড়িয়া খাল পাশের মানুষের জন্য তা আশীর্বাদ।
মধুগ্রাম খালের পাশেই মো. হাফিজুর রহমানের পাঁচটি বেড। ওই বেডে তিনি লাগান লালশাক, ঢেঁড়স, ধুন্দুল ও পটোল। এরই মধ্যে কয়েক হাজার টাকার লালশাক ও ঢেঁড়স বাজারে বিক্রি করেছেন তিনি। পটোলের ফলনও ভালো হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে পটোলও বাজারজাত করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
হাফিজুর রহমান জানান, তার নিজের কোনো জমি নেই। তাই নিজের মতো করে কোনো ফসল ফলাতে পারতেন না। বছরখানেক আগে ভাসমান বেডে সবজি চাষ শুরু করেন। ফলন ভালো হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার টাকার সবজি তিনি বিক্রি করেছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, ভাসমান বেডে সবজি চাষ ভূমিহীন কৃষকদের নতুন আলো দেখাচ্ছে। ডুমুরিয়ায় যারা ওই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন, তাদের সবাই ভূমিহীন। নিজের জন্য সবজি উৎপাদন করতে পেরে তারা খুবই খুশি। ওই সবজি দিয়ে একদিকে যেমন তাদের পরিবারের সবজির চাহিদা পূরণ হচ্ছে, অন্যদিকে বাজারে বিক্রি করেও তারা আয় করছেন। এ ছাড়া ওই সবজি সম্পূর্ণ বিষমুক্ত। উৎপাদন খরচও তুলনামূলক অনেক কম।







