Friday, December 5, 2025

খুলনার নাছিরপুর খাল উন্মুক্ত: ২০ গ্রামের মানুষের উচ্ছ্বাস

পাইকগাছা (খুলনা) সংবাদদাতা: খুলনার পাইকগাছায় তালতলা থেকে হরিঢালী পর্যন্ত বিস্তৃত বহুল আলোচিত নাছিরপুর খালটি প্রায় ৩০ বছর পর অবশেষে জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বুধবার (২ জুলাই) উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার ও দখলমুক্ত করা হয়। এই খালের ১০ কিলোমিটার এলাকার ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২০টি গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে এটি ‘জীয়নকাঠি’ হিসেবে পরিচিত।

খাল উন্মুক্তকরণের সময় স্থানীয় নারী-পুরুষসহ হাজার হাজার মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে উপস্থিত ছিলেন। এসিল্যান্ড, সেনাবাহিনী এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে খাল থেকে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা হয় এবং প্রায় ২০৫ বিঘা জায়গায় বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। তিন দশক পর খালের ওপর নিজেদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পেয়ে এলাকাবাসী মাছ ধরার আনন্দে মেতে ওঠেন।

খাল উন্মুক্ত হওয়ায় যাদের জীবন-জীবিকা এই খালের ওপর নির্ভরশীল, তাদের ঘরে ঘরে এখন আনন্দের বন্যা বইছে। গ্রামে-পাড়ায়-বাড়িতে-বাজারে মিষ্টি বিতরণ চলছে। খালের দুই পাড়ে যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। তালতলা, চিনেমলা, গোয়ালবাথান, প্রতাপকাঠি, খোলা, কাজিমুছা, রেজাকপুর, কাশিমনগর, কানাইডাঙ্গা, কপিলমুনি, হরিঢালী, সলুয়া শ্রীরামপুর, হাউলি, নাছিরপুর, রামনগর এবং মাহমুদকাঠির মানুষের কাছে বুধবার ছিল এক অন্যরকম দিন—প্রাণোচ্ছ্বাস, উৎসব আর উল্লাসের দিন। দীর্ঘকাল ধরে নানা অত্যাচার, ভয়ভীতি আর বৈষম্যের শিকার হয়ে যে দাবি তারা করে আসছিলেন, তা আজ পূরণ হয়েছে।

গত ৩০ জুন খুলনা জেলার ভূমি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জলমহাল ইজারা সংক্রান্ত কমিটির সর্বশেষ সভায় পাইকগাছার নাছিরপুর খাল উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

নাছিরপুর খাল উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে মূখ্য ভূমিকা রেখেছেন পাইকগাছা-কয়রা এলাকার জনহিতৈষী ও এলাকা উন্নয়নের রূপকল্প বাস্তবায়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সুপরিচিত সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসের চেয়ারম্যান আনোয়ার আলদীন।

দীর্ঘদিন ধরে খাল সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ সাধারণ জেলে, কৃষক, ঘের চাষী এবং সর্বসাধারণ অবরুদ্ধ ও অসহায় জীবনযাপন করছিলেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে কতিপয় ‘খালদস্যু’ দখলদার ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতারণা ও জবরদস্তির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে টাকার পাহাড় গড়েছিল। এসব জলমহাল থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষ ফসলের জন্য পানি নিতে পারতেন না, এমনকি প্রয়োজনীয় কাজেও এই পানি ব্যবহার করতে পারতেন না। যারা খালের পাশে মাছের ঘের করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, খালদস্যুরা তাদের ঘেরের সর্বনাশ করে আসছিল। বহু এলাকাবাসী তাদের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। দখলদাররা স্থানে স্থানে বাঁশের পাটা, ঘন জালের বেষ্টনী এবং নেটপাটা দিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে খালটিকে প্রায় ভরাট করে ফেলেছিল, যা খালের প্রাণ-প্রাচুর্যকে গলা টিপে মারার শামিল ছিল। এই কারণেই দীর্ঘকাল ধরে গ্রাম-গ্রামান্তরের লক্ষ লক্ষ ভুক্তভোগী মানুষ নাছিরপুর খালটি উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। খাল ঘিরে রাজনৈতিক দলের দুই গ্রুপের দখল-পাল্টা দখলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় রনক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সাধারণ মৎস্যজীবীদের মারধর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অতীতে অসংখ্যবার মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন এবং প্রেস কনফারেন্স করেও কোনো সমাধান মেলেনি।

অবশেষে খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খাল উদ্ধার ও উন্মুক্ত করার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হওয়ার পর খাল পাড়ের সাধারণ জেলে, কৃষক এবং সাধারণ মানুষ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছেন এবং মিষ্টি বিতরণ করেছেন।

বুধবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)  ইফতেখারুল ইসলাম শামীম, উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক, উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ একরামুল হোসেন, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যরা নাছিরপুর খাল অবৈধ দখলমুক্ত করার সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। খালের মধ্যে অবৈধ নেটপাটা অপসারণের কাজও শুরু হয়। খালের সাত স্থানে দেওয়া নেটপাটা পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে।

স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জানান, কপিলমুনি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন ডাবলু দীর্ঘদিন ধরে কখনো ইজারা নিয়ে আবার কখনো ইজারাবিহীন অবৈধ দখলে রেখে খণ্ড খণ্ড করে নেটপাটা দিয়ে লবণ পানির চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছিলেন। আওয়ামীলীগ শাসন আমলের শেষ দিকে আওয়ামীলীগের লোকজনই দখল লুটপাটে ব্যস্ত ছিল এবং সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করেছিল।

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর