শ্যামল দত্ত, চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি: “স্বাদে সেরা, গন্ধে ভরা খেজুর গুড়ে মনোহরা”—এই প্রাচীন প্রবাদ যেন নতুন করে বেঁচে উঠল যশোরের চৌগাছায়। ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের মেলার তৃতীয় আসর এবারও উপজেলায় গুড়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আয়োজিত হয়েছে। যশোর জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সোমবার (১৫ জানুয়ারি) সকালে তিন দিনব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম।
উপজেলা চত্বরে আয়োজিত মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক বলেন, “যশোরের ব্র্যান্ডপণ্য খেজুর রসের গুড় জাতীয় অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত হতে পারে। তবে এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও খেজুর গাছ সংরক্ষণ জরুরি।” তিনি জানান, স্থানীয় খাস জমি, নদীর ধার ও রাস্তার পাশে খেজুর গাছ রোপণের জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গত বছর উপজেলায় ৫০ লাখ খেজুর গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে, যা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় জনগণের।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা
মেলায় বক্তারা বলেন, একসময় চৌগাছা ছিল খেজুর গুড় উৎপাদনে প্রসিদ্ধ। বৃটিশ আমলে এখানকার গুড় আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হতো। তবে কালের বিবর্তনে এ ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। এই মেলার উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় গাছিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং গুড়ের চাহিদা বাড়ানো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহার সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাসমিন জাহান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
মেলায় অংশ নেওয়া সুখপুরিয়া ইউনিয়নের রমজান তরফদারের ছেলে মহিদুল ইসলাম জানান, “আমরা খাঁটি গুড় তৈরি করে মেলায় এনেছি। আশা করি, তিন দিনে লাখ টাকার বেশি গুড় বিক্রি করতে পারব।” গাছি ইসমাইল হোসেন বলেন, “খেজুর গাছ নিধন বন্ধ করলে গুড় উৎপাদন বাড়বে। সরকার যদি প্রতিবছর খেজুর গাছ রোপণের জন্য সহায়তা করে, তাহলে আমরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারব।”
মেলায় দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে গরম গরম গুড় খাওয়ার আয়োজন। খেজুর পাতার পাখা দিয়ে জ্বলন্ত তাপালে তৈরি গুড় চেখে দর্শনার্থীরা যেন হারিয়ে যান শৈশবের নস্টালজিয়ায়। মেলার স্টলে থাকা খেজুর গুড়ের তৈরি পিঠাও মন কেড়েছে দর্শকদের।
মেলার মাঠে ঐতিহ্যপ্রেমীদের জমপেশ আড্ডা মেলায় যোগ করেছে নতুন রঙ। সাংবাদিক, স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও দর্শনার্থীরা একসঙ্গে বসে স্মৃতিচারণ করেছেন পুরোনো দিনের গুড়ের মেলাগুলো নিয়ে।
গাছিরা ও স্থানীয়রা মনে করেন, খেজুর গাছ সংরক্ষণ ও নতুন গাছ রোপণে সরকারি সহায়তা এবং চাষিদের প্রশিক্ষণ দিলে গুড়ের উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া নিয়মিত মেলার আয়োজন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রাখবে।
খেজুর গুড়ের মেলার এই উদ্যোগ শুধু ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারই নয়, বরং এক সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক খাতকেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। এই মেলা চৌগাছার ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠুক—এটাই সবার প্রত্যাশা।