এইচ,এম, শহিদুল ইসলাম, মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট) প্রতিনিধিঃ ঋতু বৈচিত্রে এখন রাতের শেষে কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। আবহমান গ্রাম-বাংলায় খেজুর রস ছাড়া যেন শীতের আমেজ‘ই পাওয়া যায়না। শীতের সকালে মিষ্টি রোদে বসে বসে সুস্বাদু খেজুর গাছের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। তাই শীতের শুরু থেকেই গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহের জন্য বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে এখন গাছিরা খেজুর গাছ কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কে কত আগে খেজুর রস সংগ্রহ করতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় চলছে মোরেলগঞ্জ এর গাছিদের মাঝে।
বৈচিত্রপূর্ণ ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। এ দেশের এক একটি ঋতুর রয়েছে এক একটি বৈশিষ্ট্য। ঋতু বৈচিত্রে এখন রাতের শেষে কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা।
ক্যালেন্ডারে শীতের ঘোষণা দিলেও মানতে নারাজ আবহাওয়া ও পরিবেশ প্রকৃতি এখন আর পঞ্জিকার অনুশাসন মানছে না। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর্ব শুরু হবে। এবার কিছুটা আগেই বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় প্রান্তিক জনপদের গ্রামে গ্রামে সকালের শিশিরের সাথে অনুভ’ত হচ্ছে মৃদু শীত।
আর মাত্র কয়েক দিন পর রস সংগ্রহ করে রস থেকে লালি ও গুড় তৈরির পর্ব শুরু হয়ে চলবে প্রায় মাঘ মাস পর্যন্ত। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের প্রস্তুতি উপজেলার প্রতিটি গ্রামে চোখে পড়ছে। খেজুর রস ও গুড়ের জন্য মোরেলগঞ্জ উপজেলা এক সময় খ্যাতি ছিল। সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে, ক্ষেতের আইলে, ঝোপ-ঝাড়ের পাশে ও রাস্তার দুই ধার দিয়ে ছিল অসংখ্য খেজুর গাছ।
কোন পরিচর্যা ছাড়াই অনেকটা প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে উঠতো এসব খেজুর গাছ। প্রতিটি পরিবারের চাহিদা পূরন করে অতিরিক্ত রস দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু খেজুরের গুড়। গ্রামীন জনপদে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে পুকুরের পাড়ে রাস্তার ধারে পরিবেশ বান্ধব খেজুর গাছ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। ইট ভাটার রাহু গ্রাসে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বেশি হওয়ার কারণে যে পরিমাণ গাছ চোখে পড়ে তা নির্বিচারে নিধন করায় দিনদিন খেজুর গাছ কমছেই।
এখনও শীতকালে শহর থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম বাংলার খেজুর রস খেতে। এক সময় সন্ধ্যাকালীন সময়ে গ্রামীন পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠতো। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত সে সময়ে। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালী তৈরি করতেন।
যার সাধ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন অবশ্যই সে কথা নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হলেও বাস্তব। যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি মিষ্টি রস দেবে খেজুর গাছ। এ গাছ ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। শীতের পুরো মৌসুমে চলে রস, গুড়, পিঠা, পুলি ও পায়েস খাওয়ার পালা। এ ছাড়া খেজুরর পাতা দিয়ে আর্কষনীয় ও মজবুত পাটি তৈরী হয়। এমনকি জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার। কিন্তু জয়বায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনসহ বন বিভাগের নজরদারী না থাকায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ এখন উপজেলা জুড়ে বিলুপ্তির পথে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়ীয়া ও খাউলিয়া ইউনিয়নের গাছি কালাম মিঞা ও বারেক হাওলাদার সহ তার সহকর্মীরা জানান, আমরা পেশাগত কারণে প্রায় প্রতি বছরেই খেজুর গাছ ও বাগানের জমিতে তাবু গেড়ে ওই এলাকার খেজুর গাছ মালিকদের কাছ থেকে ৪ মাসের জন্য গাছ ভেদে ৫থেকে ৭কেজি করে খেজুরের গুড় দিয়ে গাছ গুলো আমরা নেই।
চাহিদা মত খেজুর গাছ না পাওয়ার কারণে রস কম হওয়ায় আশানুরুপ গুড় তৈরি করতে পাড়ি না। তারপরও এবছর প্রায় ২ শ’টির বেশি খেজুর গাছের মালিকদের সাথে চুক্তি করেছি। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে না দিয়ে জীবন-জীবিকার জন্য এই পেশা ধরে রেখেছি।
তবে যে ভাবে খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে অল্প দিনের মধ্যেই এই এলাকায় আর আমাদের ব্যবসা হবে না। বর্তমান বাজারে আখের গুড় চিনি যে মূল্যে বেচাকেনা হচ্ছে তার চেয়ে মানসম্পন্ন খেজুরের গুড়ের দাম এবছর কিছুটা বেশি হবে এমনটাই আসা করছেন গাছিরা। শীত একটু বেশি পড়তে শুরু করলে আত্মীয়-স্বজন আনা নেয়া ও পিঠা-পুলির উৎসবে খেজুর গুড়ের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সে সময় আমাদের লাভ একটু বেশি হয়। যে পরিমাণে শ্রম দিতে হয় সে পরিমাণে আমরা লাভ করতে পারি না। তবুও পেশাগত কারণে চালিয়ে যাচ্ছি এই ব্যবসা।
এ ব্যাপারে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জাকির হোসেনের কাছে জানতে চাইলে এ বছরে উপজেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা ১৮৫৫০পিস এর ভিতর ৫-১০ বছরের গাছ আছে ৭২৪০পিস ৫ বছরের নিচের গাছ আছে ২৮৭০পিস এবং পূর্ণ বয়স্ক গাছ রস আহরনকারী গাছের সংখ্যা ৮৪৪৫পিস।
তিনি আরও জানান, এ জন্য মৌসুম আসার সাথে সাথে দক্ষ গাছিদের কদর বাড়াতে হবে। এদিকে উপজেলার সচেতন মহল মনে করেন, খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা জীবনধারায় মিশে আছে। এই ঐতিহ্যকে যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতে হবে।
ছবি: সংযুক্ত।







