পৃথিবীতে একেক সময় একেক প্রযুক্তি আসে। সেই প্রযুক্তি মানুষের চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন—সবকিছুতেই পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেই ধারার এখন নতুন সংযোজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাচালিত (এআই) চ্যাট বট চ্যাটজিপিটি। গত নভেম্বর মাসে এর পরীক্ষামূলক ভার্সন চালু হওয়ার পর সারা বিশ্বে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। সিলিকন ভ্যালি, ওয়াল স্ট্রিট, বিদ্যায়তন, পাড়ার মোড়ের আড্ডা—সবখানেই এখন চ্যাটজিপিটি নিয়ে আলোচনা।
এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, যার হাতে যত বেশি তথ্য, পৃথিবীকে তারাই শাসন করবে। এই বাস্তবতায় কাদের হাতে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ, তা নিয়ে রীতিমতো ল্যাব বা পরীক্ষাগারে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ওপেন আই নামের একটি স্টার্টআপ মাইক্রোসফটের সহযোগিতায় চ্যাটজিপিটি নিয়ে এসেছে।
এর পরীক্ষা সফল হওয়ার পর মাইক্রোসফট তাতে আরও এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। বসে নেই গুগলও, তারা নতুন চ্যাট বট বার্ড নিয়ে এসেছে। মাইক্রোসফট ইতিমধ্যে তাদের সার্চ ইঞ্জিন ও এম এস অফিসে চ্যাট বট যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। ওদিকে চীনের সার্চ ইঞ্জিন বাইডু ঘোষণা দিয়েছে, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে সার্চ ইঞ্জিনে চ্যাট বট যুক্ত করবে তারা।
বিজ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে অর্থ ও বাণিজ্যের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের কাজে লেগেছে, করপোরেটরা তা লুফে নিয়েছে। তার বিকাশে বিনিয়োগ করেছে। অনেক করপোরেট কোম্পানির বড় বড় গবেষণাগার আছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, এবার বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে স্টার্টআপগুলোর সমন্বয় হচ্ছে। অর্থাৎ বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর নিজেদের কম্পিউটিং দক্ষতার সঙ্গে স্টার্টআপগুলোর গবেষণা কাজে লাগাচ্ছে।
অ্যানথ্রোপিক ও ক্যারেকটার এআইয়ের মতো স্টার্টআপ চ্যাটজিপিটির পাল্টা বট নিয়ে এসেছে। স্ট্যাবিলিটি এআই ছোট ছোট অনেক স্টার্টআপ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অলাভজনক সংস্থার জোট তৈরি করেছে। তারা সবাই মিলে জনপ্রিয় উন্মুক্ত মডেল নিয়ে এসেছে, যা টেক্সটকে ছবিতে রূপান্তরিত করতে পারে। এ ছাড়া চীনের সরকার-সমর্থিত সংস্থা বেইজিং একাডেমি অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সও (বিএএআই) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় অগ্রগণ্য হয়ে উঠছে। তবে ফসল ঘরে তোলার ক্ষেত্রে বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এগিয়ে—যেমন মাইক্রোসফট।
এই লড়াইয়ে কে বা কারা এগিয়ে এগিয়ে আছে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কম্পিউটার ভিশন বা ছবি বিশ্লেষণে চীনা কোম্পানিগুলো এখন এগিয়ে। মাইক্রোসফটের ক্রমতালিকায় দেখা যায়, এখন বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি কম্পিউটার ভিশন নিয়ে কাজ করা কোম্পানি চীনা। বিএএআই বিশ্বের বৃহত্তম ভাষা মডেল তৈরি করেছে, ‘উ ডাও ২ ’; মেটার কূটনৈতিক গেম সিসেরো রীতিমতো কৌশলগত বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্ক করতে পারে। ডিপমাইন্ডের মডেল ‘গো’ গেমের চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দিচ্ছে, এটা প্রোটিনের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে পারছে এবং জীবতত্ত্বের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারছে। এসব কিছু দেখে বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার জোগাড় হয়।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এখন পর্যন্ত এই লড়াইয়ে কেউই পূর্ণাঙ্গ জয় পায়নি। এ ছাড়া যাঁরা এই জগতে কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যকার পারস্পরিক সদ্ভাবও চোখে পড়ার মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়, তাঁরা একত্রে আড্ডা দিচ্ছেন, কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খবরাখবর বিনিময় করছেন। এই ডেভেলপাররা হৃদয়ে বিজ্ঞানী। তাঁরা যখন এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে কাজ করতে যাচ্ছেন, তখন শর্ত দিচ্ছেন, তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশে বাধা দেওয়া যাবে না। ফলে এ বিষয়ক জ্ঞান সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই একভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে এই প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো সারা জীবন এমন এক কাতারে না–ও থাকতে পারে। চ্যাটজিপিটি মাইক্রোসফটের বিং সার্চ ইঞ্জিনকে জনপ্রিয় করতে পারে, সেই ভাবনা থেকে গুগল ‘কোড রেড’ ছেড়েছে। ডিপমাইন্ড এত দিন গেম ও বিজ্ঞানে নজর দিয়েছে। কিন্তু এ বছরের মধ্যে তারা ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলিং বট স্প্যারো নিয়ে আসবে।
সবকিছুরই একটা ফ্যাক্টর থাকে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এই লড়াইয়ে কে বা কারা এগিয়ে যাবে, তা হয়তো শেষমেশ নির্ভর করবে কারা কতটা সংগঠিত, তার ওপর। এ ক্ষেত্রে ওপেনএআই অন্যদের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে তারা। ওপেনএআই ইতিমধ্যে চ্যাটজিপিটির পরীক্ষামূলক ভার্সন বাজারে ছেড়েছে। কোটি কোটি মানুষ তা ব্যবহার করছে। এতে এই চ্যাট বট যেমন প্রশিক্ষিত হচ্ছে, তেমনি ওপেনএআইও বুঝতে পারছে, কীভাবে কী হতে পারে।
আগে শুরু করার আরেকটি সুবিধা আছে। সেটা হলো তারা এখন ডিপমাইন্ডসহ অন্য প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর বিশেষজ্ঞদের আকৃষ্ট করতে পারছে। এই ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে গুগল, আমাজন ও মেটার মতো কোম্পানিগুলোকে নিজেদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে তারা যেভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারিতে আসছে, তাতে কাজটা অনেক সূক্ষ্মভাবে করতে হবে তাদের।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ২০২২ সালে জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপগুলো ২৭০ কোটি ডলারের তহবিল পেয়েছে। অর্থাৎ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো মনে করছে, শুধু বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোই সব করবে, তা নয়। মাইক্রোসফট, গুগল ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তা ভুল প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টা করবে। বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণের লড়াই জমে উঠতে শুরু করেছে।







