কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলন ঘিরে খুলনায় সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন পুলিশ সদস্য সুমন কুমার ঘরামি। শুক্রবার (২ আগস্ট) খুলনা নগরীতে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে চলা দিনব্যাপী দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় স্থানীয় হাসপাতালের আইসিইউ থেকে যখন স্বজনদের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয়, তখন সুমনের কন্যাশিশু এবং স্ত্রীর কান্নায় ছিল শুধু প্রিয়জন হারানোর হাহাকার।
পুলিশ সদস্য সুমন কুমার ঘরামিকে যারা পিটিয়েছেন ভিডিও ফুটেজে তাদের বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে অনুপ্রেবেশ করে আন্দোলনকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতেই এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে কিনা। আর এর পেছনে কারা তা নিয়েও চলছে জোর আলোচনা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে খুলনা নিউমার্কেটের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। পরে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে মজিদ সরণি হয়ে সোনাডাঙ্গা ও হরিণটানা থানায় গিয়ে হামলা চালায়।
আন্দোলনকারীরা বিকেল সোয়া ৩টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছান। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশও তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে চলে এই সংঘর্ষ। উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় নগরীর গল্লামারী থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ কিছুটা পিছু হটে। কয়েকজন পুলিশ জিরো পয়েন্ট এলাকায় এবং কয়েকজন গল্লামারী মোড়ে অবস্থান নেন। কয়েক দফা আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পুলিশ কিছুটা পেছনে সরে আসতে বাধ্য হয়। পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশের পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে নগরীর শিববাড়ি মোড়ের দিকে যেতে চাইলে সন্ধ্যা ৬টার দিকে গল্লামারী মোড়ে আরেক দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় ওই পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন পুলিশ কনস্টেবল সুমন। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক।
পিটিয়ে হত্যার ভিডিও
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, কনস্টেবল সুমনকে পিটিয়ে হত্যার বর্বর দৃশ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে ওই ভিডিও ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার একটি ফুটেজ সময় সংবাদের হাতেও এসেছে।সুমনকে পেটানোর ঘটনায় সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের ভিডিওতে দেখা গেলেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া
ভিডিওতে যা দেখা গেল
শতাধিক মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে এসে সুমনকে ঘিরে ফেলে। একটি রেস্টুরেন্টের রান্নাঘর থেকে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, সুমনকে ঘিরে ফেলার পর গলায়, মুখে লাল কাপড় লাগানো কয়েকজন তরুণ সুমনকে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। লাঠি, রড, বাঁশসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে একপর্যায়ে সুমন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর হামলাকারীরা ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। এ হামলায় নেতৃত্ব দেয়া বেশ কয়েকজনকে সুমনের অন্য এক সহকর্মীকে হামলার নির্দেশ দিতেও শোনা যায় ভিডিওতে। তাদের বলতে শোনা যায়, ওই যে ওই দিকে আরকেটা আছে। ধর, ধর…।
যা বলছেন পুলিশ কমিশনার
কমিশনার মোজাম্মেল হকের দাবি, শুক্রবারের কর্মসূচি ঘিরে পুলিশ অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। উল্টো আন্দোলনকারীরা হামলা চালিয়ে প্রায় ৩০ জনের মতো পুলিশ সদস্যকে আহত করেছেন। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা ছিল গুরুতর। তাদের একজন ছিলেন স্থানীয় এএসপির বডিগার্ড সুমন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পুলিশ কমিশনার মোজাম্মেল হকের অভিযোগ, হামলাকারীরা সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
সুমন হত্যায় মামলা, আসামি ১২০০
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় খুলনায় পুলিশ কনস্টেবল সুমন ঘরামী হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয়ে ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
লবণচরা থানার এসআই মোস্তফা সাকলাইন বাদী হয়ে শুক্রবার (২ আগস্ট) রাতে লবণচরা থানায় মামলাটি করেন। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় এখনও কেউ গ্রেফতার নেই বলে জানান লবণচরা থানার ওসি মমতাজুল হক।