Saturday, April 27, 2024

নিজের ছেলেই বোঝা ভেবে রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রমে

- Advertisement -

স্বামী-সংসার নিয়ে ভালোই চলছিল আছিয়ার। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পর এক ছেলেকে নিয়ে সতিনের সংসার করতে হয়। বৃদ্ধ বয়সে একটু সুখের আশায় সতিনের সংসারে সব কষ্ট সহ্য করেও বাবার বাড়ির জমি বিক্রি করে ছেলেকে বড় করেন। ছেলে এখন আয়-উপার্জন করতে শিখেছে। আছিয়া এখন বৃদ্ধ, বয়সের ভারে নিজের কাজ ছাড়া কিছুই করতে পারেন না। সতিনের সংসারেও রয়েছে এক ছেলে। সৎ মাকে বোঝা ভেবে সে রেখে যায় বৃদ্ধাশ্রমে।

সেটা জানতে পেরে কিছু দিন পর নিজের ছেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে গেলেও ছেলের বউ দেখতে পারেন না আছিয়াকে। ছেলের সংসারেও অযন্ত-অবহেলা শুরু হয়। কখনো আধা পেট, কখনো না খেয়ে থাকতে হয় তাকে। নিজের কষ্টের কথা ছেলেকে বললে উল্টো বউয়ের কথা শুনে মাকেই বকাঝকা করতো ছেলে। ছয় দিন না খেয়ে থাকার পর শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। এবার রেখে গেছে তার আপন ছেলে। যশোরের নিমতলা এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বয়সী আছিয়া বেগম। স্বামী-সন্তান থাকতেও তার ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।

অন্যদিকে স্বামীর মৃত্যুর পর বৃদ্ধা রোকেয়া বেগমের খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন দুই ছেলে। কখনো আধা পেট, কখনো না খেয়ে দিন কাটছিল তার। কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। অর্ধাহারে–অনাহারে অনেক কষ্টে দিন কাটছিল। এখন তার ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। থাকা–খাওয়ার সুযোগ থাকায় সুদূর কুষ্টিয়া শহর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে।

এমনিভাবে কেউ ছেলের সংসারে বোঝা হয়ে, কেউবা স্বামী মারা যাওয়ার পর অসহায় হয়ে, কেউবা খাবারের অভাবে আশ্রয় নিয়েছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর জোড়াপুকুরিয়া বৃদ্ধাশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আছিয়া-রোকেয়ার মতো ২২ জন বৃদ্ধার মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ইসমত আরার (৫৫) বৃদ্ধাশ্রমে। ইসমত আরা উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের মৃত শফি উদ্দিন বিশ্বাসের স্ত্রী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহে দুটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। দুটিই ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে শহরের পাগলাখানা এলাকায় রয়েছে একটি বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে অল্প কিছু বৃদ্ধার ঠাঁই হয়েছে। অপরটি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামে অবস্থিত জোড়াপুকুরিয়া বৃদ্ধাশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। সেখানে ২১ জন বৃদ্ধার আশ্রয় হয়েছে। ২০০৬ সালে ১২ জন বৃদ্ধা মাকে নিয়ে চালু হওয়া জোড়াপুকুরিয়া বৃদ্ধাশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচলনা করেন ইসমত আরা। প্রথমে এখানে টিনের ছাউনি ও পাট খড়ির বেড়া দেওয়া ঘর থাকলেও ২০১৯ সালে জেলা পরিষদ জাইকা প্রকল্পের অর্থায়নে তিন রুমের একটি ভবন নির্মাণ করে দেয়। ২০২২ সাল থেকে উপজেলা পরিষদ থেকে ২০০ কেজি চাল ও ১০ হাজার টাকা করে বাজার খরচ দেওয়া হয়। তবে এটা যথেষ্ট নয়। প্রতি মাসে এখন ৩১০ কেজিরে বেশি চাল এবং ৪০ হাজার টাকার বাজার বেশি বাজার খরচ লাগছে। এছাড়াও কাপড় ধোয়ার সাবান, গায়ে মাখার সাবান, গায়ে মাখার তেলসহ ব্যবহারিক সকল পণ্য ক্রয় করতে হয় ইসমত আরার।

বৃদ্ধাশ্রমটি শুরুর প্রথম দিকে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হতো। নিজের হস্তশিল্প কারখানার আয় দিয়ে ওই খরচ মেটাতেন ইসমত আরা । স্বামীর আয়ে চলেছে সংসার আর তার আয়ে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম। এখন রমজান মাসে বাড়তি কোনো খরচ পান না। তাই রমজানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের দেওয়া উপহার এবং ব্যক্তি আয়োজনে চলে ইফতার ও সেহরির খাবার।

সরেজমিনে জোড়াপুকুরিয়া বৃদ্ধাশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধা মায়েরা সবাই ইফতারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইফতারির প্রস্তুতি চলাকালীন সময়ে সবাই মিলে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। তাদের ইফতার মেনুতে কিছু মুড়ি, খেজুর, কলা, বেগুনি, অল্প কিছু ছোলা এবং স্যালাইনের শরবত রয়েছে। কারো মুখেই দুঃখের কোনো ছাপ নেই। ইসমত আরা নিজ হাতে সবার মাঝে ইফতার বিতরণ করে দিচ্ছেন। বোঝার উপাই নেই এটা কোনো বৃদ্ধাশ্রম। সব দেখে মনে হয়েছে এটা তাদের সুখের সংসার, যেখানে কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইসমত আরা, তারা সবাই তার সন্তান।

ইফতার শেষে বৃদ্ধা আছিয়া বেগম বলেন, প্রথমে সতিনের ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছিল। কিছুদিন থাকার পর নিজের ছেলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে নিজের ছেলেই আমাকে রেখে যায়। বাড়িতে ছয় দিন খেতে দেয়নি, বৃদ্ধাশ্রমে এসে খেয়েছি। এখানেই আমি অনেক ভালো আছি। ঠিকমতো গোসল করছি, রোজা থাকছি, ইফতার করছি, বাড়ির থেকে এখানেই অনেক ভালো আছি। কেউ খোঁজ রাখে না, বৃদ্ধাশ্রমের মা ছাড়া আমার বলতে আর কিছুই নেই।

সদর উপজেলার ডাকবাংলা এলাকার সেফালি বেগম বলেন, ছেলে-বেটার বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পরে তারা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরে এই বৃদ্ধাশ্রমের কথা জানতে পেরে এখানে চলে আসি। ছয় মাস হয়েছে এখানে আসছি, কেউ খোঁজ খবর নেয়নি। বাড়ির থেকে এখানে মায়ের কাছে অনেক ভালো আছি।

বৃদ্ধা কাজলী বেগম বলেন, ছেলেমেয়ে ছোট থাকতেই স্বামী মারা যান। তখন থেকেই কষ্ট করে তাদের মানুষ করছি। অভাবের সংসারে ছেলেদেরই চলে না। আবার নিজের দেহের ভিতরে রোগে বাসা বেঁধেছে। এজন্য এখানে চলে আসছি। এখানে আসার পর ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছে প্রতিমাসে রক্ত দেওয়া লাগবে। নিজের কাছে তেমন কোনো টাকা-পয়সা না থাকায় ওষুধ কিনে খেতে পারি না। মা ইসমত আরা, সেই আমাদের দেখাশোনা করে। শুধু রমজান মাস না, সব সময় আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করে।

নিমরী খাতুন বলেন, শুরু থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে আছি। বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করতে অনেক কষ্ট করেছেন ইসমত আরা। এখনো করে যাচ্ছেন। নিজের ব্যবসার সব আয় বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয় করছেন। হাতের কাজের কারখানার আয়ও বৃদ্ধাশ্রমে খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকার কিছু মানুষ সহযোগিতা করেন।

প্রতিবেশী কলম বলেন, ২০০৬ সালে এই বৃদ্ধাশ্রামটি চালু হয়েছে। তখন থেকেই ইসমত আরা এটা দেখাশোনা করেন। আগে পাটখাড়ির বেড়া ছিল, ২০১৯ সালের দিকে এই ভবনটা হয় এবং উপজেলা পরিষদ থেকে অল্প কিছু সহযোগিতা পান। তবে এটা যদি সরকারিভাবে দেখভাল করার সুযোগ থাকতো তাহলে হয়তো আরও ভালোভাবে চলতো। এখানে একজন ডাক্তার এবং নার্স প্রয়োজন যারা এই মায়েদের নিয়মিত দেখাশোন করতে পারবে।

জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের আয়ুব হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামের ইসমত আরা খুব কষ্ট করে এই প্রতিষ্ঠানটি চালায়। যাদের ছেলেমেয়েরা মায়েদের খেতে দেয় না, খুব কষ্টে রাখে, তাদের এই বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা হয়। ইদানিং সরকারিভাবে কিছু কিছু অনুদান পায়। কিন্তু অল্প অনুদানে এদের চলে না। ইসমত আরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চেয়ে চিন্তে, এনজিও থেকে ঋণ করে, নিজে হস্তশিল্পের কাজ করে এই বৃদ্ধাশ্রমটি চালান। এই বৃদ্ধাশ্রমটি চালাতে গিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া ৫ বিঘা জমিও বিক্রি করতে হয়েছে।

বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার আগ্রহ জানতে চাইলে ইসমত আরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিয়ে হওয়ার পর যখন আমি এই গ্রামে আসি, তখন দেখি গ্রামের মানুষের খুব অভাব। কেউ দুই বেলা খেতে পারতো না। সেই থেকে যে বৃদ্ধারা ভিক্ষা করতে আসতো তাদেরকে খেতে দিতাম। এভাবে চলতে থাকে, তখন এই খবর অন্য বয়স্ক মহিলদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, তখন থেকে খাবারের সময় হলেই কিছু বৃদ্ধা চলে আসতো। এরপর আমাদের গ্রামের এক পুত্রবধূর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য না করতে পেরে প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা কীটনাশক পান করেছিলেন। চিকিৎসায় ওই নারী বেঁচে ফিরলেও তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেননি তার সন্তানরা। অসহায় অবস্থা দেখে ওই নারীকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিই। এরপর পাড়ার আরও দুই-তিনজন বৃদ্ধা তার কাছে আশ্রয় নেয়। এ ঘটনার পর তার মাথায় বৃদ্ধাশ্রম তৈরির ভাবনা আসে। তখন স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে ১২জন বৃদ্ধাকে নিয়ে টিনের ছাউনি ও পাটখড়ির বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ করে বৃদ্ধাশ্রমের যাত্রা শুরু করি।

তিনি বলেন, বৃদ্ধাশ্রম শুরুর প্রথম দিকে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হতো। পল্লী নকশা নামের নিজের হস্তশিল্প কারখানার বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে যে টাকা আয় হতো, তা দিয়ে ওই খরচ চালাতাম। স্বামীর আয়ে চলেছে সংসার, আর আমার আয়ে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম।

ইসমত আরা বলেন, এখন বৃদ্ধাশ্রমের পরিধি বেড়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাকে ৫ শতক জমি দিতে বলেন। তখন স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ৫ শতক জমি লিখে দেই বৃদ্ধাশ্রমের নামে। এরপর জেলা পরিষদ ২০১৯ সালে তিন কক্ষের একটি পাকা ঘর বানিয়ে দিয়েছে। সেখানে বৃদ্ধারা আরামে থাকতে পারছেন। বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয়ও বেড়েছে। এখন মাসে ৩০০ কেজির বেশি চাল লাগে। বাজারে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন বাজার লাগে ১ হাজার  ৫০০ টাকার। তেল, সাবানসহ প্রসাধনী সামগ্রীতে মাসে খরচ হয় তিন-থেকে চার হাজার টাকা। এ ছাড়া বৃদ্ধাদের ওষুধ, কাপড়, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। সব মিলিয়ে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা মতো খরচ হয়। বৃদ্ধাদের পরনের কাপড় জাকাতের কাপড় থেকে হয়ে যায়, যার ফলে নিজে থেকে আর বাড়তি কাপড় কেনা লাগে না।

তিনি বলেন, অসহায় নারীরা ধর্মীয় বই পড়ে ও গল্প করে সময় কাটান। নামাজের সময় হলে সবাই একত্রে নামাজে চলে যান। তাদের আরবি পড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের কোনো কাজ করতে হয় না। নিয়ম করে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম সবই দেওয়া হয় তাদের। রমজান মাসে সরকারিভাবে কোনো কিছুই পাইনি। তারপরও কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠান রমজান উপলক্ষ্যে কিছু খেজুর, ছোলা এবং মুড়ি দিয়েছিল। সেগুলো দিয়ে তো আর বেশি দিন চলে না। আমাকেই কষ্ট করে তাদের ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করতে হয়। মায়েদের ইফতারিতে থাকে ছোলা, মুড়ি, কলা, খেজুর ও শরবত। রাতে সেহরিতে নিয়মিত দুধ-কলার পাশাপাশি সবজি-মাছ এবং পালাক্রমে মাংস ও ডিম দেওয়া হয়। তবে রমজানে মায়েদের ভালো কিছু খেতে দেওয়ার আশা থাকলেও সাধ্য নেই। তারপরও মায়েদের দেখভাল করতে পেরে অনেক ভালো লাগে।

হরিণাকুন্ডু পৌরসভার মেয়র মো. ফারুক হোসেন বলেন, অনেক কষ্ট করে ইসমত আরা এই বৃদ্ধাশ্রমটি গড়ে তুলেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে কষ্ট করেই বৃদ্ধাদের দেখভাল কর যাচ্ছেন। ইসমত আরার বৃদ্ধাশ্রমটি এখন অজপাড়াগাঁয়ের একটি মডেল হয়ে গেছে। আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকি। আমরা সব সময় খোঁজখবর নিই। এলাকার বৃদ্ধারা এখন আর নিজেদের অসহায় মনে করেন না। তারা পরিবার থেকে বিতাড়িত হলে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন।

রাতদিন-সংবাদ:-

- Advertisement -

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত