Monday, April 29, 2024

তাকওয়া, সংযম ও সহমর্মিতার বার্তা নিয়ে আসে মাহে রমজান

- Advertisement -

মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী- আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগ তিতীক্ষার আহ্বান নিয়ে প্রতিবছর আমাদের মাঝে ফিরে আসে দীর্ঘ অপার রহমতের মাস মাহে রমজান। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয় এই মাস। রহমত, মাগফিরাত এবং দোজখ থেকে পরিত্রাণ লাভের এই মাসের সঙ্গে বছরের অন্য কোনও মাসের তুলনা চলে না। কারণ এ মাসেই নাজিল হয়েছে সর্বশেষ ও সর্বোৎকৃষ্ট আসমানি গ্রন্থ কোরআন। এ মাসেই পাওয়া যায় এমন একটি রাত, যার ইবাদত-বন্দেগি হাজার রাতের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। যে রাতের প্রাপ্তির জন্য পূর্ববর্তী নবীরা পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন।

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বর্ণনানুযায়ী এ মাসের একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদতের সমতুল্য। আর একটি নফল ইবাদত একটি ফরজ ইবাদত বলে আল্লাহ দরবারে বিবেচিত হবে। এই পবিত্র মাসের প্রথমাংশে আল্লাহ তায়ালা মুমিন রোজাদারদের উপর রহমত বর্ষণ, মধ্যমাংশে তাদের গুনাহ মাফ এবং শেষাংশে দোজখ থেকে মুক্তি দান করেন। এ ছাড়াও আরও অসংখ্য ফজিলত ও অপার বরকত এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তে বিদ্যমান।

একজন মানুষের জীবনের সার্বিক সফলতা ও বিভিন্ন মানবিক গুণাবলি বিকাশের জন্য সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিত্ব গঠনেও সংযমের গুরুত্ব অপরিসীম। যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার মধ্যে সংযম অবলম্বনের শক্তি নেই, তার মধ্যে কোন বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ববোধ সৃষ্টি হতে পারে না। ব্যক্তিত্বের যথার্থ বিকাশের জন্যে নিজের প্রবৃত্তি ও আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করা অপরিহার্য। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের গুণাবলি সৃষ্টি হয়। নিজের প্রবৃত্তির উপর বিবেক ও ইচ্ছাশক্তির প্রাধান্য স্থাপিত হয়। মানুষের যে কয়টি মূল চাহিদা রয়েছে, তার মধ্যে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা অন্যতম।

সিয়াম সাধনা এসব চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিক্ষা দেয়। টানা ৩০ দিনের সিয়াম সাধনা মানুষের মধ্যে প্রবল ইচ্ছাশক্তির সঞ্চার করে। তাকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে রোজার দিনে জৈবিক চাহিদা আর ইচ্ছাশক্তির লড়াইয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি তার ইচ্ছাশক্তিকে শাণিত ও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়। প্রবৃত্তির লাগামহীন প্রবণতা সংযত হয়ে বিবেক ও ইচ্ছাশক্তির হাতে আত্মসমর্পণ করে। ফলে এক সংযত ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবন গঠনে সক্ষম হয় একজন মানুষ। বস্তুত সিয়াম সাধনা সংযত ও নিয়ন্ত্রিত জীবন গঠনের এক বলিষ্ঠ কর্মসূচি। এর যথার্থ অনুশীলন আমাদের জীবনে বয়ে আনে প্রভূত কল্যাণ, সৃষ্টি করে সংযম, আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলিষ্ঠতা এবং বিবেকের প্রাধান‌্য আর শাণিত ব্যক্তিত্ব।

সিয়াম সাধনার মর্যাদা ও বিশেষত্বের পেছনে প্রচ্ছন্ন কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত রোজা আসলে একটি অদৃশ্য ও গোপন ইবাদত। তাই এই ইবাদতটি গোপনভাবে কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যই নিবেদিত হয়ে থাকে। রোজার কোনও দৃশ্যমান অবয়ব ও অস্তিত্ব নেই। যেমন- অন্যান্য ইবাদত নামাজ, যাকাত, হজ ইত্যাদির বাহ্যিক ও দৃশ্যমান অবয়ব রয়েছে। তাছাড়া রোজা নিয়তের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রোজাদার আল্লাহ রেজামন্দি ও খুশনুদী অর্জনের লক্ষ্যে রোজায় নিয়ত করে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড হতে বিরত থাকে।

রোজাদারের এই মানসিক দৃঢ় চিত্ততা কেউ বাইরে থেকে দেখতে পায় না, অবলোকন করতে পারে না। কেউ যদি প্রকৃত পক্ষে রোজাদার না হয়েও বলে বসে যে, আমি রোজাদার, তা বাইরে থেকে কেউ সঠিক ও বেঠিক বলে মন্তব্য করতে পারে না বা তাকে মিথ্যাবাদী রূপে সাব্যস্ত করতে পারে না। মানসিক এই নিয়ত ও উদ্দেশ্যকে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন, বোঝেন ও উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তিনি রোজাকে একান্তভাবে নিজের বলে ঘোষণা করেছেন এবং এর প্রতিফল কত বড় হবে, তা নির্ধারণের বিষয়টি নিজের কাছে গোপন রেখেছেন। সিয়াম সাধনার প্রকৃত অবস্থা ও পরিমণ্ডল অনুসারে আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময় প্রদান করবেন।

রমজানের শিক্ষা ধৈর্য ও সংযম। রমযানের একটি নাম হচ্ছে শাহরুল মুওয়াসাত তথা সহমর্মিতার মাস। একে অপরের প্রতি সম্প্রীতি, সমবেদনা ও সহমর্মিতা রমযানের মহান শিক্ষা। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মুসলমানদের ওপর নানা দিক থেকে আক্রমণ আসছে, নানা ষড়যন্ত্রের শিকার। অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক হামলা, অপপ্রচার সব মিলিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা নিতে হবে সংযমের উৎকর্ষ থেকে। যেকোনও উসকানি ও ষড়যন্ত্রে হুটহাট মাথা গরম করে ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে সংযম ও তাকওয়া রক্ষা করে চলাই রমযানের শিক্ষা।

আমাদের দেশে সহমর্মিতার একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও ক্রেতা-ভোক্তাসাধারণের হাতের নাগালে রাখা। খাদ্যে ভেজাল না মেশানো এবং ওজনে কমবেশি না করা। মনে রাখতে হবে, ইসলাম শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম নয়, এর মূল বাণীই হচ্ছে মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি অকৃত্রিম গভীর আনুগত্য এবং মানবতার উৎকর্ষ। এ কারণে একজন প্রকৃত রোজাদার প্রচণ্ড তৃষ্ণা সত্ত্বেও গোপনে পানি পান করে না। অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকলে এটি কখনও সম্ভব হতো না। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয়। তার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে থাকার অনুভূতি তীব্র হয়। মানবতার তরে ত্যাগ ও সহমর্মিতার অনুশীলন হয়। এভাবেই অর্জিত হয় তাকওয়া, যা মুমিন জীবনের মহামূল্যবান গুণ।

- Advertisement -

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত