Friday, December 5, 2025

যমুনার পর পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানিতেও ডিজেল ঘাটতি

যমুনার পর এবার পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানিতেও পাওয়া গেছে ডিজেলের বড় ধরনের ঘাটতি। চট্টগ্রাম থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে সরবরাহের পর হিসাব মিলছে না প্রায় দেড় লাখ লিটার ডিজেলের। ডিপোর ট্যাংক ও পাইপলাইনের মিটারে কোনো ত্রুটি আছে কি না—তা এখন খতিয়ে দেখছে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)—যাদের অধীনে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেল বিপণন কোম্পানিগুলো কাজ করে—তাদের অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকেই এই ঘাটতির তথ্য পাওয়া গেছে।

ট্যাংকের গভীরতা মাপা নিয়ে সন্দেহ

ডিপো-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে ডিপ স্টিক দিয়ে ট্যাংকের গভীরতা মেপে তেলের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এই মাপজোখে সামান্য—মাত্র দুই মিলিমিটার—কম দেখানো গেলেই প্রায় ১ হাজার ১৮০ লিটার ডিজেল কম দেখানো বা চুরি করা সম্ভব। অতীতে যমুনার ফতুল্লা ডিপোতেও ট্যাংকের সক্ষমতা বাড়তি দেখানো নিয়ে একই ধরনের অনিয়ম ধরা পড়েছিল। পদ্মা ও মেঘনার ক্ষেত্রেও সক্ষমতা পুনরায় যাচাই করলে প্রকৃত পরিস্থিতি পরিষ্কার হতে পারে।

পরীক্ষামূলক সরবরাহ ও ঘাটতির হিসাব

চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে তেল সরবরাহ চলছে। ফলে ঘাটতির সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো নিশ্চিত না হলেও মিটার ত্রুটি, ট্যাংকের সক্ষমতায় ভুল বা তাপমাত্রাজনিত ঘনত্ব পরিবর্তন—সবকিছুই তদন্তের আওতায় এসেছে।

মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, ১০ নভেম্বর পাইপলাইনে ২৫,৩৭,৭২৪ লিটার ডিজেল পাঠানো হলেও ডিপোতে পাওয়া গেছে ২৪,২২,৪৭৩ লিটার—ঘাটতি ১,১৫,২৫১ লিটার, যা ৪ শতাংশের বেশি। অথচ অনুমোদিত ক্ষতির মাত্রা সর্বোচ্চ ০.৩৩ শতাংশ।

পদ্মা অয়েল পিএলসির ক্ষেত্রে ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ২৫,২০,৭৭০ লিটার ডিজেল পাঠানো হয়, কিন্তু ডিপোতে পাওয়া যায় ২৪,৯৩,৪৬৮ লিটার—ঘাটতি ২৭,৩০২ লিটার। তবে পদ্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, দুই প্রান্তের মিটারের হিসাবে বরং প্রায় ১,৮০০ লিটার তেল বেশি দেখাচ্ছে, যা তাপমাত্রাজনিত কারণে ট্যাংকে মাপার সময় কম দেখাতে পারে।

বিলম্বে শেষ হওয়া প্রকল্পের বাস্তবতা

২০১৬ সালে শুরু হওয়া চট্টগ্রাম–ঢাকা পাইপলাইন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। তিন দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর এ বছরের মার্চে কাজ শেষ হয়। প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২,৮৬১ কোটি টাকা, যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩,৬৯৯ কোটি টাকায়। প্রকল্পটি এখনো হস্তান্তরের পর্যায়ে থাকায় বিপণন কোম্পানিগুলো মিটারভিত্তিক পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়নি।

প্রকল্প পরিচালক বলছেন, পাইপলাইনে তেল ‘গায়েব’ হওয়ার সুযোগ নেই—এটি অবশ্যই কোনো স্থানে আছে, যা মিটার ও ট্যাংকের সক্ষমতা যাচাইয়ের পর ধরা পড়বে।

যমুনা ডিপোতে সক্ষমতা বাড়ল ৭৭ হাজার লিটার

যমুনার ফতুল্লা ডিপোতে ঘাটতি ধরা পড়ার পর তদন্তে দেখা যায়, দুইটি ট্যাংকের সক্ষমতা আগের হিসাবের চেয়ে ৭৭,৪৯২ লিটার বেশি। অর্থাৎ শুরুতে ইচ্ছাকৃতভাবেই সক্ষমতা কম দেখানো হয়েছিল বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। ট্যাংকের নতুন ‘স্ট্র্যাপিং’ অনুযায়ী আগের তুলনায় ট্যাংক ২২-এ ৬৬,১৮৭ লিটার এবং ট্যাংক ২৩–এ ১১,৩০৫ লিটার বেশি ধারণক্ষমতা পাওয়া গেছে।

চুরি রোধে নতুন তদন্ত ও ব্যবস্থা

গণমাধ্যমে পরপর তেল চুরির খবর প্রকাশের পর নভেম্বরে বিপিসির ঢাকা অফিসে জ্বালানিসচিবের সভাপতিত্বে সভা হয়। সেখানে শ্রমিক সংগঠনের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত নজরদারি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি কারিগরি ও অপারেশন বিষয়ক তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, “জাহাজ থেকে পাম্প পর্যন্ত তেল চুরি সাধারণ ঘটনা। চুরি ঠেকাতে পাইপলাইন করা হয়—তবুও যদি তেল গায়েব হয়, তবে এর পেছনে বড় ধরনের অনিয়ম আছে। স্বার্থ-সংঘাতমুক্ত কমিটি বা আদালতের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হওয়া জরুরি।”

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর