Friday, December 5, 2025

৬ অস্ত্রসহ আটক বেনাপোলের গোল্ড নাসির খালাস

যশোরে ৬ অস্ত্র ও ১৯ টি গুলিসহ আটক শীর্ষ চোরাকারবারি নাসির উদ্দীনকে খালাস প্রদান করেছে যশোরের একটি আদালত। এ নিয়ে আদালত পাড়ায় চলছে নানা গুঞ্জন। মোস্ট ওয়ান্টেড নাসিরের খালাস হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এলাকাবাসীও। আদালত বলছে, সাক্ষীর দুর্বলতা ও আইনগত ক্রুটির কারণে খালাস পেয়েছেন নাসির। তবে সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন, এব্যপারে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। তারা এও বলছেন এর নেপথ্যে রয়েছে অন্যকিছু। বাদী পক্ষের আইনজীবী, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, পেশকারসহ বিচার সংশ্লিষ্টদের যোগসাজসে তিনি খালাস পেয়েছেন। এদিকে, মামলার নথি গোপনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আজ অব্দি মামলার মুল নথি কাউকে দিচ্ছেনা আদালত সংশ্লিষ্টরা। তবে, নাসির খালাসের এ রায় সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পিপি স্বাচ্ছ্বন্দে মেনে নিলেও মেনে নিতে পারেননি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি । ইতিমধ্যে এ রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন যশোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি।

তথ্য অনুসন্ধানে উঠে আসে, আওয়ামীলীগ শাসন আমলে বেনাপোলের পুটখালি গ্রামের বুদো সর্দারের ছেলে নাসির উদ্দিন সরদার ওরফে গোল্ড নাসির ছিলো এক আরোচিত নাম। যার বিরুদ্ধে অস্ত্র চোরচালান, সোনা চোরাচালান, ভারতীয় বিভিন্ন মালামাল চোরাচালানের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সেসময় তাকে আটকে বিজিবি থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট বারবার অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া মার্কেট এলাকায় দেশি-বিদেশি ৬টি অস্ত্র ও ১৯টি গুলি এবং চারটি খালি ম্যাগজিনসহ তাকে আটক করা করে র‌্যাব। এ ঘটনায় মামলা করেন র‌্যাবের ডিএডি শেখ নুরুজ্জামান চানু। মামলাটি তদন্ত করেন তৎকালীন শার্শা থানার অফিসার ইনচার্জ আকিকুল ইসলাম। তিনি নাসিরের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও জমা দেন। এরপর দ্রুতই এ মামলায় চার্জগঠন করা হয়। চলে একের পর এক সাক্ষী শুনানি। সর্বশেষ গত ১০ জুলাই যশোরের স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল ৪ এর বিচারক এসএম আশিকুর রহমান এ মামলার রায়ে নাসিরকে খালাস প্রদান করেন। রায়ের পর ঘটনাটি অনেকটা গোপন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে ।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি একেক সময় একেক রকম তথ্য দেন। কখনো জানান, নথি জেলা জজের কাছে আবার কখনো বলেন সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক নথিটি রেখে দিয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল ৭ সেপ্টেম্বর যেয়ে ওই নথির বিষয়ে জানতে চাইলে পেশকার জিল্লু বলেন, ওই নথি বিচারক রেখে দিয়েছেন। তার কথাবার্তায় নানা অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এদিকে, খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ঘটনাটি নজরে এসেছে জেলা বিএনপির সভাপতি ও আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুর । সম্প্রতি তিনি এ রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

ওই সূত্র ধরে মামলার নথি ও রায়ের কপি সংগ্রহ করা হয়। বিশ্লেষণে জানা যায়, এ মামলায় মোট নয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের প্রথমে রয়েছেন অভিযানে থাকা র‌্যাবের এএসআই চঞ্চল কুমার মজুমদার। এছাড়াও সাক্ষ্য দিয়েছেন মামলার বাদী শেখ নুরুজ্জামান চানু, অভিযানে থাকা র‌্যাবের এসআই আলামিন নায়িম, দুই সদস্য মহিউদ্দিন শেখ ও রাজিব শরীফ, তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আকিকুল ইসলাম। এ ছয়জন সকলেই অস্ত্র গুলি উদ্ধার ও আটকের বিষয়ে পরিপূর্ণ সাক্ষ্য দেন। এরবাইরে তিনজন সাক্ষ্যদেন। তারা হলেন, স্থানীয় সাক্ষী রফিকুল ইসলাম, হোসেন আলী এবং জব্দ তালিকায় সাক্ষরকারী মিলন হোসেন। তাদের বক্তব্য তারা অস্ত্র উদ্ধারের সময় দেখেননি। আটকের পর নাসিরকে দেখেছেন। এদিকে, বিচারক রায়ে উল্লেখ করেছেন পাবলিক সাক্ষীরা অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়নি। এছাড়া অস্ত্র আইনের ১২ ধারার রেফারেন্স টেনে বলেছেন, অস্ত্র উদ্ধার করতে হলে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। অর্থাৎ আইনগত দিক ও পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে নাসিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে রষ্ট্রপক্ষ। ফলে খালাস প্রদান করা হয় গোল্ড নাসিরকে। অন্যদিকে, অস্ত্রগুলো অবৈধ ঘোষনা করেন তিনি। একই সাথে আটকের সময় তার কাছে থাকা নগদ সাড়ে ৫ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন বৈধ বলে নাসিরকে ফেরতের নির্দেশ দেন বিচারক এসএম আশিকুর রহমান।

এ বিষয়ে যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম বলেন, এ রায়ের ক্ষেত্রে অস্ত্র আইনের ১২ ধারায় যে ব্যখ্যা দেয়া হয়েছে সেটা সঠিক না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ফৌজদারীর কার্যবিধি আইনের ৫৩ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, অফিসার অস্ত্র উদ্ধার করতে পারবেন। পরে আসামিকে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। এক্ষেত্রে র‌্যাবের যিনি অস্ত্র উদ্ধার করেছেন তিনিও একজন অফিসার। এবং সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমেই আদালতে সোপর্দ করা হয় নাসিরকে। এছাড়া উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারী সাক্ষীদের অবিশ্বাস করা যাবেনা। তাদের সাক্ষ্যের উপর সাজা দেয়া যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় সাক্ষীর উপর নির্ভর করা হয়েছে। যা অস্বাভাবিক বলে দাবি করেন কাজী ফরিদুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, এ মামলার রায়ের ক্ষেত্রে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো মালখানা থেকে আদালতে উপস্থাপনের আদেশ দেয়া হয়নি। সেটাও অস্বাভাবিক। এ বিষয়ে কথা হয় যশোরের অন্তত ৪/৫জন সিনিয়র আইনজীবীর সাথে। তারাও একই কথা বলেন।
এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম যশোরের আহবায়ক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি দেবাশীষ দাস বলেন, নাসির চিহ্নিত অপরাধী। সে অস্ত্র ও সোনা কারবারীর সাথে জড়িত সেটা গোপনের কোনো সুযোগ নেই। আসামির শরীর থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করেছে র‌্যাব। এখানে আইনগতভাবে খালাসের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া এ সম্পর্কে উচ্চ আদালতেও অসংখ্য সিদ্ধান্ত রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে পিপির দায়িত্বে অবহেলা আছে। উদ্দেশ্যে প্রনোতিতভাবে অতিদ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয়েছে। সর্বশেষ তিনি বলেন, আলোচিত এমন মামলায় অস্ত্রসহ আটক আসামি খালাশ পেলে তারা আরও বেপোরোয়া হয়ে উঠবে। আইনশৃঙ্খলা বিগ্নিত হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলবে। এছাড়াও বিচার ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে । অনৈতিক যোগসাজসে এ মামলার রায় ঘোষনা হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে অতিরিক্ত পিপি আকরাম হোসেন বলেন, সাক্ষী শুনানীর সময় তিনি হজে ছিলেন। তিনি জানতে পেরেছেন স্বাক্ষীর দূর্বল সাক্ষর কারনে নাসির খালাশ পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তার সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন কারও সাথেই হয়নি। তবে তিনি বলেছেন, মুলত নাসির স্বাক্ষীদের টাকা খাইয়ে কিনে ফেলেছেন। ফলে সকলেই নাসিরের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। রায়ের সময় তিনি উপস্থিত থাকলেও এ ক্ষেত্রে সরকার পক্ষের আর কিছুই করার ছিলোনা।

এ বিষয়ে যশোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পিপি সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, বিষয়টি তার নজরে আসা মাত্রই তিনি উচ্চ আদালতে এ রায়ের বিপক্ষে আপিল করেছেন। তিনি আশাবাদী রাষ্টপক্ষের দাবি উচ্চ আদালত গ্রহন করে রায় বাতিল করা হবে।

যশোর জেলা আইনজীবনী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমএ গফুর বলেন, এ ক্ষেত্রে যদি কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ হয়ে থাকে। আর তার সাথে যদি আইনজীবী সমিতির কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। সমিতি থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র: গ্রামেরকাগজ

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর