শ্যামল দত্ত, চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে খ্যাত যশোরের চৌগাছা উপজেলার গরীবপুর গ্রামের স্মৃতি আজ মুছে যেতে বসেছে। ১৯৭১ সালের ২১ ও ২২ নভেম্বর গরীবপুর-জগন্নাথপুর এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর এক তীব্র সম্মুখযুদ্ধ। সেই যুদ্ধক্ষেত্র সংলগ্ন গরীবপুর নিউ মার্কেট মোড় থেকে গরীবপুর পূর্বপাড়া গোপাল মণ্ডলের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি বর্তমানে চরম বেহাল অবস্থায় রয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাটি কাদায় ডুবে যায়, সৃষ্টি হয় গর্ত ও জলাবদ্ধতা।
বুধবার (৩০ জুলাই) সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জনদুর্ভোগ চরমে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন শিশু শিক্ষার্থী, কমিউনিটি ক্লিনিকের রোগী, নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লি এবং ভ্যান ও ইজিবাইকচালকরা।
স্থানীয়রা জানান, বহু বছর আগে এই রাস্তাটির পাশে একটি পাথরের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়, যেখানে লেখা রয়েছে— বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: গরীবপুরের যুদ্ধক্ষেত্র, ২১শে নভেম্বর ১৯৭১। বর্তমানে সেই স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে যাওয়ার পথে। এলাকার প্রবীণ রফিউদ্দিন বলেন, এই রাস্তাটির পাশেই যুদ্ধ হয়েছিল, এখান দিয়ে মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করেছিল। এখন সে রাস্তায় শিশুরাও চলতে পারে না, ভ্যানচালকরা রোজগার বন্ধ করে বসে থাকে।
গ্রামের আরেক বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, যে রাস্তাটার দুই পাশে যুদ্ধের স্মৃতি, সেটাই পড়ে আছে অবহেলায়। সামান্য কিছু জায়গায় সলিং করা হলেও তা পুকুরধস ও পানির চাপে ধসে পড়েছে।
ইউপি সদস্য আশিকুর রহমান জানান, আমরা চাই এই রাস্তাটি পিচিংসহ পূর্ণ পুনর্নির্মাণ হোক। ধস ঠেকাতে প্যালাসাইড নির্মাণ ও কালভার্ট স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরও জানান, প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার মানুষ এই রাস্তায় চলাচল করেন, যা এখন কার্যত অচল।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ঈদের দিন দুপুর ২টায় পাকবাহিনী গরীবপুর-জগন্নাথপুর এলাকায় গোলাবর্ষণ শুরু করে। শুরু হয় তীব্র ট্যাংক যুদ্ধ। একপর্যায়ে যুদ্ধ এতটাই কাছাকাছি চলে আসে যে হাতাহাতির লড়াই পর্যন্ত হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ৭টি ট্যাংক হারিয়ে চৌগাছা হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে চৌগাছা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক রাশিদুল ইসলাম রিতম বলেন, এই রাস্তা শুধু চলাচলের পথ নয়, এটি ইতিহাসের পথে হাঁটার এক জীবন্ত প্রতীক। রাস্তার করুণ অবস্থা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল বার্তা দিচ্ছে। দ্রুত রাস্তা সংস্কার ও স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী রিয়াসাত ইমতিয়াজ জানান, গরীবপুর সড়কটি ভিপিপি প্রকল্পে প্রস্তাব আকারে উর্ধ্বতন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে এবং তালিকাভুক্ত হয়েছে। অনুমোদন পেলেই দ্রুত কাজ শুরু হবে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ উভয় বিবেচনায় দ্রুত রাস্তা সংস্কার, পুনর্নির্মাণ, প্যালাসাইড ও কালভার্টসহ প্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজের দাবিতে এলাকাবাসী কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অন্যসব রাস্তায় উন্নয়ন হলেও গরীবপুর যুদ্ধক্ষেত্র সংলগ্ন এই রাস্তাটি এখনো অবহেলিত, অথচ এটি কেবল চলাচলের পথ নয়—একটি জাতির আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার ইতিহাস বহনকারী ঐতিহাসিক প্রান্তর।
আর কে-০৬







