যশোরের শারমিন সাথীর অনন্য সাহসের গল্প
যখন মঞ্চ আলোয় ঝলমল, দর্শক নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে চরিত্রে চরিত্রে হারিয়ে যান, তখন কেউ কি ভাবেন — সেই মঞ্চের আলোয় দাঁড়িয়ে যিনি দর্শকদের মোহিত করছেন, তার হৃদয়ের গভীরে আরেকটি জীবন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে?
হ্যাঁ, বলছি শারমিন সাথীর কথা। যশোরের ব্যঞ্জন যশোর নাট্যদলের এই নিবেদিতপ্রাণ অভিনয়শিল্পী গর্ভে আট মাসের সন্তান ধারণ করেও বৈশাখী লোকনাট্য উৎসবের মঞ্চে অভিনয় করেছেন পূর্ণ উপস্থিতি আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। নাটকটির নাম — ‘চন্দ্রহত্যা’। চরিত্রটি — চাঁদের বুড়ি।
দর্শকের অধিকাংশই জানতেন না, মঞ্চে যার নিপুণ ভঙ্গি, প্রাণবন্ত সংলাপ, সজীব অভিব্যক্তি তাদের মাতিয়ে তুলেছে — তিনি তখন অন্তঃসত্ত্বা। যখন জানা গেল, অনেকেই অবাক হন। আবার সেই অবাকভাব মিশে যায় শ্রদ্ধায়। কেউ বললেন, “এটা তো কেবল অভিনয় নয়, এটা এক সংগ্রামী মায়ের ভালোবাসার প্রকাশ।”
শারমিন সাথীর নাট্যজীবনের সূচনা হয় ২০১১ সালে, উদীচীর একটি অভিনয় কর্মশালার মধ্য দিয়ে। এরপর পথ চলে ২০১৬ সালে ‘বিবর্তন যশোর’ নাট্যদলে। ২০১৮ সালে ভারতের আন্তর্জাতিক থিয়েটার অলিম্পিকে ‘মাতব্রিং’ নাটকে অভিনয় করেন। নাটকের প্রতি তার আগ্রহ, নিষ্ঠা ও নেতৃত্বের ফলেই ২০২২ সালে গড়ে তোলেন নিজের দল — ব্যঞ্জন যশোর।
এই দলের মাধ্যমে তিনি নাটক মঞ্চায়ন করছেন নিয়মিত। অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাও দিয়েছেন ‘আজব কেচ্ছা’ ও ‘মাথায় ঘোরে বই’ নাটকে। নাট্যচর্চা, অনুশীলন, মঞ্চসজ্জা — সবকিছুতেই তিনি একনিষ্ঠ।
গর্ভবতী অবস্থায় অভিনয় করা প্রসঙ্গে শারমিন সাথী রাতদিন নিউজকে বলেন, “শরীরিক কষ্ট ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি থামতে পারিনি। এটা শুধু নাটক নয়, এটা আমার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ। আমি চাই, আমার সন্তান যেন জানে — তার মা নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখিয়েছে।”
শারমিন মনে করেন, আজকাল অনেক অ্যাথলেট, নৃত্যশিল্পী গর্ভাবস্থায়ও চর্চা চালিয়ে যান। সেখান থেকে সাহস পেয়েছেন তিনিও।
“আমি চাই, আমার সন্তানের প্রথম স্পন্দন হোক মঞ্চের শব্দে, আলোর ঝলকে। শিল্পই হোক তার জন্মপরিবেশ।”
নাটকের নির্দেশক আসিফ খান জানান,“নাটকটি লেখার সময় থেকেই চাঁদের বুড়ি চরিত্রে সাথীর মুখ ভেসে উঠছিল। কিন্তু তার গর্ভাবস্থা নিয়ে চিন্তা ছিল। তারপরও যখন দেখি তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, তখন আর দ্বিধা করিনি। মঞ্চে তার আত্মস্থতা দেখে দর্শকেরা বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন।”
শারমিন সাথী কেবল একজন অভিনেত্রী নন, তিনি একজন সংস্কৃতি যোদ্ধা। যখন সমাজ নারীকে শুধু মমতাময়ী মা বা গৃহিণীর ছকে দেখতে চায়, তখন শারমিন দেখিয়ে দেন — একজন নারী তার মাতৃত্ব ও স্বপ্নকে একসাথে বহন করতে পারেন।
এই ঘটনা শুধু যশোর নয়, গোটা দেশের নাট্যজগতের জন্য এক শক্তিশালী বার্তা। এক সাহসী নারী কিভাবে শিল্প ও জীবনের ভারসাম্য বজায় রেখে এগিয়ে চলতে পারেন, তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন শারমিন সাথী।