Friday, December 5, 2025

১১৬ বছরের অন্ধ মুয়াজ্জিন: বাঁশ ও দড়ি ধরে প্রতিদিন মসজিদে যান

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের বড়দেহা গ্রামের মো. আব্দুর রহমান মোল্লার জীবন যেন এক বিস্ময়কর অধ্যায়। ১১৬ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ দীর্ঘ ২১ বছর ধরে দৃষ্টিহীন অবস্থায়ও ইসলামের পথ ধরে রেখেছেন নিজেকে। মনের চোখে আলোকিত এই মানুষটি প্রতিদিন বাঁশ ও দড়ি ধরে মসজিদে গিয়ে আজান দেন, নামাজ পড়েন এবং এলাকাবাসীর হৃদয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ইসলামের ইতিহাসে এমনই এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.), যিনি ছিলেন অন্ধ কিন্তু তবুও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে আজান দিতেন। আজকের এই সময়ে ১১৬ বছর বয়সী অন্ধ মুয়াজ্জিন আব্দুর রহমান মোল্লা যেন সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন।

প্রায় ২১ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারান আব্দুর রহমান মোল্লা। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে তিনি নিজের ইবাদত-বন্দেগির পথে বাধা হতে দেননি। নিজের বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত বাঁশ ও দড়ির সাহায্যে একটি পথ তৈরি করেন, যা ধরে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে যান তিনি। প্রথমদিকে ছেলে-নাতিরা তাকে সহায়তা করতেন, পরে তিনি নিজেই অভ্যস্ত হয়ে যান এই পথচলায়।

২০১১ সালে বড়দেহা গ্রামে নিজের পাঁচ শতাংশ জমির ওপর একটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন আব্দুর রহমান মোল্লা। এই মসজিদ এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। শুধু মসজিদ নির্মাণ করেই থেমে যাননি, বরং সেটিকে আল্লাহর ঘর হিসেবে নিবেদিত করে দেন। সেই থেকে বিনা পারিশ্রমিকে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।

পরিবারে তার দুই স্ত্রী ও ২৫ জন সন্তান ছিলেন, যার মধ্যে ছয়জন ইন্তেকাল করেছেন। বর্তমানে তার ১৯ জন সন্তান জীবিত রয়েছেন। বড় ছেলে মো. শফিকুল ইসলাম সাইফুল জানান, বাবা সবসময়ই ঈমান ও ইসলামের পথে অটল ছিলেন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরও তিনি কখনো নামাজ ছাড়েননি।

তার আরেক ছেলে মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা ১১৬ বছর বয়সে এসেও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেন এবং নামাজ পড়েন। এটি আমাদের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা।’

নাতি মো. নাইম হোসাইন জানান, ‘দাদার দৃঢ় মনোবল দেখে আমিও উৎসাহিত হয়েছি। এখন থেকে নিয়মিত মসজিদে যাই, নামাজ পড়ি। দাদার জীবন আমাদের জন্য এক শিক্ষণীয় উদাহরণ।’

নিজের জীবন সম্পর্কে আব্দুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘মহান আল্লাহ পাক আমাকে এখনো সুস্থ রেখেছেন। দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারালেও মনোবল হারাইনি। আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমি প্রতিদিন মসজিদে যেতে পারি, আজান দিতে পারি। এটাই আমার জীবনের পরম শান্তি।’

খামারনাচকৈড় হাফেজিয়া মাদরাসার মুফতি হাফেজ মাওলানা মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘রাসূল (সা.)-এর যুগেও আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) অন্ধ ছিলেন, কিন্তু তিনি আজান দিতেন। আব্দুর রহমান মোল্লার জীবনের এই অধ্যায়ও ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ পাক তার এই মহৎ কাজের জন্য নিশ্চয়ই তাকে পুরস্কৃত করবেন।’

আব্দুর রহমান মোল্লার এই জীবনগাঁথা শুধুমাত্র স্থানীয় এলাকাবাসীর জন্য নয়, বরং পুরো দেশের মানুষের জন্য এক দৃষ্টান্ত। তার অবিচল নিষ্ঠা ও দৃঢ় মনোবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার মতো একটি বিষয়। ধর্মীয় অনুভূতি, মানবতার শিক্ষা এবং জীবনসংগ্রামের বাস্তব উদাহরণ হিসেবে তার কাহিনী বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

তার এই জীবনযাত্রা প্রমাণ করে, বাধা যত কঠিনই হোক না কেন, ইচ্ছাশক্তি ও ঈমান থাকলে সবকিছু সম্ভব। মহান আল্লাহ পাক যেন এই মহান মানুষটিকে সুস্থ রাখেন ও তার মহৎ কাজের প্রতিদান দেন—এটাই সবার কামনা।

এই অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনী যদি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তাহলে অবশ্যই শেয়ার করুন যাতে আরও বেশি মানুষ তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারে!

আরো পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত

এই বিভাগের আরো খবর