ওয়াসি মোহাম্মদ সাদিক: যশোর শহরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সামনের একটি পুরনো বাড়ি রয়েছে, যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই জানেন না, এই বাড়িটি বিখ্যাত বিজ্ঞানী নীলরতন ধর এবং তাঁর পরিবারের। নীলরতন ধর শুধু যশোর নয়, গোটা বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরবময় নাম। এই বাড়িটি তাঁর বাবা প্রসন্ন কুমার ধরের বাড়ি ছিল। প্রসন্ন কুমার ধর ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী এবং স্বদেশি আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যা যশোরবাসীর জন্য গর্বের বিষয়।
নীলরতন ধরের অবদান
নীলরতন ধর ছিলেন ভৌত রসায়ন বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ। যশোরে ১৮৯২ সালের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করা এই মহান ব্যক্তি শিক্ষা জীবনে প্রতিটি স্তরে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। তিনি যশোর জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এম.এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরে লন্ডন ও প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অফ সায়েন্স’ ডিগ্রি অর্জন করেন। নীলরতন ধরের গবেষণা কার্যে ছয়শোর বেশি মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তিনি ১৯৩৮, ১৯৪৭ এবং ১৯৫২ সালে নোবেল পুরস্কার কমিটির রসায়ন বিভাগের বিচারক হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।
এছাড়া, তিনি মাটির নাইট্রোজেন সংরক্ষণ, সার থেকে নাইট্রোজেন পুনরুদ্ধার এবং ফটো-কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তাঁর এই গবেষণা কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করে। তিনি বিজ্ঞান জগতের এমন একজন নক্ষত্র ছিলেন, যাঁর কাজের স্বীকৃতিতে তিনি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন।
নীলরতন ধরের পরিবারের অন্যান্য সদস্য
নীলরতন ধরের ভাইয়েরাও ছিলেন তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। তাঁর ভাই জীবনরতন ধর ছিলেন যশোর জেলার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। জীবনরতন ধরের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে যশোরে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত জীবনরতন ধর অবসর নেওয়ার পর যশোর শহরের গুরুদাস বাবু লেনে বসবাস করতেন। যশোরের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ১৯৪৯ সালে তিনি ভারতে চলে যান এবং ১৯৫১ সালে বনগাঁ আসনে কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত হন।
বর্তমান অবস্থা
যশোর শহরের এই ঐতিহাসিক বাড়িটি আজও রয়েছে। এটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সামনে রয়েছে বাড়িটি। তবে দুঃখের বিষয়, এই বাড়িটি এখনও যশোরবাসীর কাছে বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে বা জাদুঘর হিসেবে গড়ে ওঠেনি। অথচ এই বাড়িটি বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলার জন্য অনন্য ভূমিকা রাখতে পারত। যদি এই বাড়িটি নীলরতন ধরের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য একটি বিজ্ঞানাগার বা বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হতো, তবে তা কেবল যশোর নয়, গোটা দেশের জন্য গৌরবের বিষয় হতো।
ঐতিহ্য রক্ষার দাবি
শিক্ষাবিদ ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, এই বাড়িটিকে সংরক্ষণ করা হোক এবং এখানে বিজ্ঞান চর্চার একটি কেন্দ্র বা জাদুঘর স্থাপন করা হোক। যশোরের সন্তান নীলরতন ধরের স্মৃতি চিরজীবী করতে হলে এই উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি হবে এক অনন্য উদাহরণ এবং গর্বের বিষয়।
নীলরতন ধর এবং তাঁর পরিবারের অবদান আমাদের গৌরবের প্রতীক। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখা এবং তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।







