শফিয়ার রহমান, মনিরামপুর প্রতিনিধিঃ সৌমেন মন্ডল একটি বেসরকারি আইটি ফার্মে মাত্র ৪দিন যোগদানের মাথায় কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়। চাকরীর সুবাদে সে ঢাকার মোহাম্মদপুর বসিলায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে সামিল হয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যার একটু আগে মিছিলে মিছিলে মুখরিত হওয়ার সময় হঠাৎ কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সৌমেন। সে এখন বাড়িতে বিছানায় যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। তার চোখে-মূখে এখন শুধুই আতংক। সেদিনের সেই ছবি চোখে ভাসতেই আতংকে উঠে।
মঙ্গলবার তার বাড়িতে গেলে এ চিত্র চোখে পড়ে।
সৌমেন মন্ডল যশোরের মণিরামপুর পৌর এলাকার বিজয়রামপুর গ্রামের শিক্ষক দম্পতি পশুপতি মন্ডল ও রমা রানী মন্ডলের ছেলে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাবা-মার মূখে হাসি ফুটানোর একরাশ আশা নিয়েই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই ভর্তি হয় ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স শেষ করে চলতি বছর জগন্নাত বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন সে। যার ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। এরমধ্যে ফাস্ট আইটি ফার্মে চাকরি হয় সৌমেনের।
সেদিনের সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সৌমেন মন্ডল বলেন, তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুর বসিলা এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার জুম্মা নামাজের পরেই ছাত্রজনতার মিছিলে এলাকায় উত্তাল হয়ে পড়ে। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মোহাম্মদপুরের বসিলায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা মিছিল বের করে। তিনি ওই মিছিলে যেতেই পুলিশের আক্রমনের শিকার হয়।
তিনি আরও বলেন, উপর থেকে হেলিকপ্টারে মিছিলে গুলি করা হচ্ছিল। আর নিচ থেকে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই উরুরতে কিছু একটা লেগেছে বলে অনুভুতি হয়। কিছুক্ষণ পর দেখতে পান তার পরিহিত প্যান্ট রক্তে লাল হয়ে গেছে। পরে ছাত্র-জনতা তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে দেখতে পায় উরুতে গুলি লেগে নাভির নিচ দিয়ে বের হয়ে গেছে। এতে উরুর হাড় ভেঙ্গেও গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যেহেতু গুলি বের হয়ে গেছে এবং উরু একটা স্পর্শকাতর জায়গা হওয়ায় অস্ত্রোপচার ঝুকিপূর্ণ। তবে, হাড় এমনিতে জোড়া লেগে যাবে তাকে আশ্বস্ত করেছেন চিকিৎসক।
সৌমেনের শিক্ষক দম্পতি বাবা-মামা বলেন, অর্থের দিকে না তাকিয়ে নিজেরা কষ্টে চলে দুই সন্তানের মধ্যে বড় সৌমেনকে ইঞ্জিনিয়ার করার আশায় ঢাকায় ভর্তি করেন। ছেলেকে নিয়ে তাদের চোখে-মূখে এখনো আতংকের ছাপ। ছেলেটা ভাল হয়ে আর দশ জনের মত স্বাভাবিক হাটাচলা করতে পারে-এজন্য দেশবাসীর কাছে আশির্বাদ কামনা করেছেন।
এদিকে অন্ধ হতে চলেছে চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় আহাদ হোসেন। সে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আহাদ হোসেন গত ৫ আগস্ট মিছিলে সামিল হলে চোখে বুলেট বিদ্ধ হয়। এখন সেও বাড়িতে চোখের যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। আন্দোলনের সফলতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মঙ্গলবার তার বাড়িতে গেলে এ চিত্র চোখে পড়ে।
আহাদ একই উপজেলার বলিয়ানপুর গ্রামের মৃত সাহেব আলীর ছেলে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে একটি ঢাকার একটি কোচিং-এ ভর্তি হয়। ভর্তির সুবাদে আহাদ মালিবাগ এলাকায় থাকেতেন।
সেদিনের সেই লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, মিছিল রামপুরা এলাকায় পৌছাতেই পুলিশ তাদের শান্ত থাকতে বলেন। তারা শান্ত হয়ে বসে থাকতেই হঠাৎ রাবার বুলেট তার চোখে এসে লাগে। তখন সে আর কিছুই দেখতে পায় না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আহাদের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। স্বজনরা আহাদ হোসেনের চিকিৎসা ও সুস্থ্যতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। মা রাজিয়া বেগম ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে চোখের পানি শাড়ির আঁচল দিয়ে বার বার মুছছিলেন।
আহাদ হোসেনের বড় ভাই মুরাদ হোসেন বলেন, ঢাকায় দুইবার চোখের অপারেশন হলেও গুলি বের হয়নি। দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে চোখের জটিলতা ততই বাড়ছে বলে আশংকা করছেন চিকিৎসকরা।
এসময় কিছুটা ক্ষোভ করেই আহাদ হোসেন বলেন, তাদের আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও এখনো কেউ তার খোঁজ খবর নেয়নি। অনেকেই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। সে কি এই জন্যই জীবন বাজি রেখে দেশকে নতুন করে স্বাধীন করেছেন? এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আহাদ হোসেন।
আর কে-০২
