Wednesday, May 22, 2024

টপ-সয়েল যাচ্ছে ভাটায় : সুন্দরবন সংলগ্ন ইটভাটাগুলোয় নির্বাধায় পুড়ছে কাঠ

- Advertisement -

কপিলমুনি (খুলনা) প্রতিনিধি ॥ পাইকগাছায় অবৈধ ইটভাটায় নির্বাধায় পুড়ছে হাজার হাজার মন কাঠ। ইটভাটায় শুধু এলাকার বৃক্ষরাজি উজাড় হচ্ছে না, আবাদি ভূমির উপরি অংশ টপ সয়েল যাচ্ছে। স্রোতের বেগে উজাড় হচ্ছে সামাজিকসহ প্রাকৃতিক বন।

অধিকাংশ ইটভাটা সরকারি নদ ভরাটি জায়গা দখল করে পরিচালিত হচ্ছে। ভূমিদস্যুরা বছরের পর বছর ইটভাটায় সরকারি জমির মাটি বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর সরকারি সম্পদ-সম্পত্তি নষ্ট বা গ্রাস করলেও সংশ্লিষ্টরা নিরব। গত ১ জানুয়ারি পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকায় ৬টি ইটভাটায় ৭ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আসিফুর রহমান। উপজেলার চাঁদখালী ইউনিয়নের আল্লাহর দান ব্রিক্স এর মালিক আব্দুল জলিলকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার, সামিন ব্রিক্স মালিক সিরাজুল ইসলামকে ১ লক্ষ, বিবিএম ব্রিক্স মালিক আব্দুল মান্নানকে ১ লক্ষ, এমএস ব্রিক্স মালিক মুনছুর আলী গাজীকে ১ লক্ষ, সরদার ব্রিক্স মালিক চাঁদখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহাজাদা আবু ইলিয়াসকে ১ লক্ষ ও গদাইপুর ইউনিয়নের পুরাইকাটি ফাইব ষ্টার ব্রিক্স এর মালিক সরদার মুজিবুর রহমানের নিকট থেকে ২ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এসময় পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়ায় অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনার করায় মালিকদের জরিমানা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যারা লোকায়ে ও কৃষি জমিতে ইটভাটা করেছে তাদেরকে পরিবেশের ছাড়পত্র দেয়া হবে না। তাদের ইটভাটার স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার জন্য বলেছি। তারা যদি সরিয়ে না নেয় তাহলে পরবর্তিতে ভেঙ্গে দেয়া হবে। কিন্তু থেমে নেই, ইটভাটায় পুরোদমে চলছে ইট প্রস্তুতের কার্যক্রম। পাশাপাশি স্কেভেটর দিয়ে কৃষি আবাদি জমিসহ নদী ভরাটি সরকারি জায়গা থেকে ভূমিদস্যুরা মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছে।

ইটভাটাগুলো ফসলী জমি, বসতবাড়ি ও বিদ্যালয় মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, উল্টো আইনের প্রতি বৃদ্ধাঅঙ্গুলি দেখিয়ে চাঁদখালীতে ৭টি ইটভাটার মধ্যে স্টার ব্রিক্স মালিক আব্দুল হালিম খোকন, এমবিএস ব্রিক্স মালিক হাজী শফি গাজী, আল্লাহর দান ব্রিক্স মালিক আব্দুল জলিল সরদার, বিবিএম ব্রিক্স মালিক আব্দুল মান্নান, এডিপি ব্রিক্স মালিক মো. মহিউদ্দিন খান ও একই উপজেলার রাড়–লী এসএমবি ব্রিক্স মালিক মিঠুন সরদার ইটভাটায় নির্বাধায় হাজার হাজার মন কাঠ পুড়াছেন। ইট তৈরীর কাঁচামাল মাটি আসছে সরকারি জমি থেকে। স্কেভেটর দিয়ে দিনরাতে আবাদি ভূমির উপরি অংশ টপ-সয়েল কেটে আনা হচ্ছে। ট্রাকে মাটি আনতে নষ্ঠ হচ্ছে সরকারি পিচের রাস্তা। রাস্তা মাটি পরে বর্ষা মৌসুমে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা সাধারন মানুষের। সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন উজাড়ে আরএক মাধ্যম কাঠ কয়লার চুল্লি। এ চাঁদখালী ইউনিয়নে প্রায় একশত চুল্লিতে কাঠ পুড়িয়ে বানানো হচ্ছে কয়লা। পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গত বছর সেপ্টম্বর মাসে ৫টি কয়লার চুল্লি ধ্বংস করেন। এসময়ে স্কেভেটর দিয়ে ৫টি চুল্লি ধ্বংস করা হয়। বাকি চুল্লিগুলো বন্ধ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মানবিক কারনে ১ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ ও অপসারণ করার শর্তে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাদা আবু ইলিয়াস মুচলিকা দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেন। এক মাসের পরিবর্তে ৫ মাস অতিবাহিত হলেও চুল্লি বন্ধ না করে, উল্টো পুরোদমে চলছে। এমনকি নতুন করে আরো চুল্লি তৈরী করা হচ্ছে। মো. লাভু গাজী ৯টি, হালিম রেজা মিঠু ৭টি, আব্দুল হালিম খোকন ৭টি, জিয়াউর রহমান কমল ৫টি, জয়নাল হোসেন ৫টি, সেলিম রেজা লিটু ৩টি, হাইদার সরদার ৩টি, আজিজুর রহমান ৪টি ও শাহীন হোসেন ৩টি। এ ৯জন ৪৬টি ও বাকি প্রায় ৫০টি চুল্লি ৩০জন পরিচালনা করছে। বিশ্বের-সব চেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সংলগ্ন ইটভাটা ও চুল্লিতে পুড়ছে কাঠ। একটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মন পর্যন্ত কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতিবার কমপক্ষে ২৫ হাজার মন কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতিমাসে প্রত্যেকটি চুল্লিতে ৩ থেকে চারবার কাঠ পুড়িয়ে কয়লা করা হয়। ফলে প্রতিমাসে কয়লার চুল্লিতে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মন কাঠ পোড়ানো হয়। ফলে ইটভাটা ও কয়লা চুল্লিতে রাতদিন পোড়ানো হচ্ছে অবাধে গাছ। এতে ধ্বংস হচ্ছে আশেপাশের প্রাণ-প্রকৃতি। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। ইটভাটাগুলোর একটিতেও নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এরপরেও বছরের পর বছর চলছে ইটভাটা ও কয়লা চুল্লি। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ এর ৬ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানী হিসেবে কোন জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না’। আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘জেলা প্রশাসকের নিকট হতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবেন না’। ৫নং ধারায় আছে, ‘কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হতে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল ব্যবহার করা যাবে না’। ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌঁশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত উপজেলা বা ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করে কোন ব্যক্তি ভারি যানবাহন দ্বারা ইট বা ইটের কাঁচামাল পরিবহন করা যাবে না’ মর্মেও এ আইনে উল্লেখ আছে। আইনের ৮ ধরার ৩(খ) উপধারায় উল্লেখ আছে, ‘বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতীত সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা হতে ২ কিলোমিটার দুরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না’। এ আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন অমান্য করলে অনধিক ৩ বৎসরের কারাদন্ড বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন’। ইট পুড়াতে কাঠের ব্যবহার সহ সরকারি জায়গার উপর এমবিএস ব্রিক্স মালিক হাজী শফি গাজীর মুঠোফোনে মন্তব্য নিতে গেলে রিসিভ করে দু’দিন একাধিকবার একটু পরে বলে লাইন কেটে দেন। ৫টি চুল্লি মালিক জিয়াউর রহমান কমল বলেন, চুল্লি ব্যবসা আমাদের নেশা ও পেশা। ভাটা, সমিল সহ মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। চুল্লি বন্ধের আগে এগুলো বন্ধ করা হোক। ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাদা আবু ইলিয়াস বলেন, আমার ভাটাটি লোকালয় থেকে দূরে এবং জ্বালানী হিসাবে ভাটায় এক টুকরাও কাঠ ব্যবহার করা হয় না। আমি চুল্লি বন্ধ করতে না পারায় ইউএনও স্যারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। থানা ওসি মো. জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, ভাটা মালিকদের নোটিশের মাধ্যমে জানানো হবে চলাচলে রাস্তায় মাটি পরিস্কারে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম বলেন, উপরের স্যারদের জানিয়েছি। ইটভাটায় সরকারি সম্পত্তি থাকার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আগামী সপ্তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (উপসচিব) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ইটভাটা ও চুল্লিতে আগেও দু’বার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। আবারো ব্যবস্তা নিবেন বলে জানান এ কর্মকর্তা।

- Advertisement -

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত