Sunday, May 19, 2024

টিটিই শফিকুলকে নিয়ে গর্বিত পরিবার ও গ্রামবাসী

- Advertisement -

ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় পরিচয়ে তিন যাত্রীকে বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করায় জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) শফিকুল ইসলাম। এরপর রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। শুরু হয় দেশুজুড়ে সমালোচনা। তারপর রেলমন্ত্রীর নির্দেশে শফিকুলকে আবার দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের দুই দিন পর কাজে যোগ দেন। চিলাহাটিগামী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনে দায়িত্ব পালন শুরু করেন শফিকুল। রাত ৯টা পর্যন্ত তিনি বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে ২৯ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন।

তার বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া গ্রামে। এ গ্রামের রজব আলী শেখ ও শুকজান নেছার দম্পতির বড় ছেলে শফিকুল। ২ ভাই ১ বোনের মধ্যে শফিকুল বড় ছেলে।

বাড়িতে ঢুকতেই দেখা যায়, তার বাবা মাঠ থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ছাগলের জন্য ঘাস কাটছেন। তার মা ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। বাড়িতে দুজন ছাড়া আর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। টিনের তিন রুমওয়ালা একটি ঘর ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। ১৪ শতক জমির ওপর টিনের তিন কক্ষের একটি ঘর। মাঠে নেই কোনো জমি। সারা দিন ক্ষেতখামারে কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই কোনো রকম সংসার চলে।

পরিবার জানায়, ছোট থাকতে অন্যের বাড়িতে বড় হয়েছেন শফিকুলের বাবা। বিয়ের পর ১৪ শতক জমি কিনে সেখানেই তিন রুমের একটি টিনের ঘর করে থাকেন। অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন। এক বেলা খেয়ে আরেক বেলা উপোস থেকে স্কুলে গেছে দুই ভাই।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই টিউশনি করতেন শফিকুল। তখন থেকে তার পড়াশোনার খরচ নিজেই চালিয়েছেন। বাবার ওপর কখনো বোঝা হতে হয়নি। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ছোট ভাইকেও লেখাপড়া করিয়েছেন টিউশনির টাকা দিয়ে।

শফিকুল নবগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করেন। তারপর পারিবারিক কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে ২০১২ সালে অনার্স ও ২০১৩ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে অনার্সে পড়া অবস্থায় চাকরি পান বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) হিসেবে।

ব্যক্তিজীবনে এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। তার মেয়ে এবার ঈশ্বরদীর একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী, আর ছেলে পড়ে ক্লাস ওয়ানে। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঈশ্বরদী শহরের পূর্বটেংরি পাড়ার কেন্দ্রীয় গোরস্তানের পূর্ব পাশে ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি।
৯ বছর ধরে সততার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। চাকরির টাকা দিয়ে মাঠে এক শতক জমি তো দূরের কথা, বাবার ভিটায় একটা ভালো বাড়িও বানাতে পারেননি শফিকুল।

শফিকুলের বাবা রজব আলী শেখ জানান, বাড়ির জমি মাত্র ১৪ শতক। মাঠে নিজের কোনো জমি না থাকায় পরের জমিতে কামলার কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষবাদ করেন। পাশাপাশি গরু-ছাগল লালনপালন করেন।

ছেলে শফিকুলের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জানান, ছেলেকে পড়ালেখা করানোর কোনো সামর্থ্য ছিল না তার। তাই ছোট থেকে টিউশনি করতে হয়েছে শফিকুলকে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেও ভর্তির টাকা দিতে পারেননি তিনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি শফিকুল। তাই দিনরাত ৪টি ব্যাচে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যান। পাশাপাশি ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও চালিয়েছেন।

রজব আলী শেখ বলেন, হঠাৎ চাকরি থেকে বরখাস্তের খবরে আমরা কোনো টেনশন করিনি। কারণ, আমি জানি আমার ছেলে কোনো অন্যায় করেনি। সে তার ডিউটি সে পালন করেছে। কিন্তু আমাদের দুঃখ একটাই, আমার সৎ ছেলেকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। তাকে নিয়ে আমিসহ গ্রামের সবাই গর্ব করি। শফিকুল আমাদের গর্বের সন্তান। তার কাজে আমরা খুশি।

শফিকের দাদি বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলেকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে ওদের বড় করেছি। আমার দুই ছেলেও অন্যের বাড়িতে কাজ করে পরিবার চালাইছে। আমার নাতিরাও অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে। তারাও অন্যের বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি করছে। আমার শফিকুল খুবই ভালো। তার মতো ভালো ছেলে গ্রামে আর নেই।

প্রতিবেশী সাইফুল জানান, শফিকুলের বাবা পরের বাড়িতে কাজকর্ম করেন। সন্তানদের কোনো দিন ভালো পোশাক-আশাক দিতে পারেননি। তারা শুধু ভালো ছাত্র ছিল এবং টিউশনি করে নিজে লেখাপড়া করেছে বিধায় এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। একটা সরকারি চাকরি করতে পারছে। কিন্তু একজন টিকিট না কেটে ট্রেনে উঠেছে, সে জানতে চাওয়ার কারণে তাকে সাময়িক বরখস্ত করা হয়। তার সঙ্গে যে কাজটি করা হয়েছে, সেটা অন্যায়। সে যদি অসৎ হবে, তাহলে তাদের এই বাড়িঘর থাকার কথা না। তারা এখনো মাঠে এককাঠা জমিও কিনতে পারেনি। শুধু শফিকুল সৎ বলেই তার এই সাময়িক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

শফিকুলের ছাত্র রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমি দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন শফিকুল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছি। তখন দেখেছি অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও সততার সঙ্গে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজে ও ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। তার পরিবারের অভাব-অনটনের কারণেই তিনি এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রাইভেট পাড়িয়ে সৎভাবে টাকা উপার্জন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।

তিনি সততার সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকরি করেন। স্যারের সঙ্গে যেটা ঘটেছে, সেটা আসলে ঠিক হয়নি। সরকারের কাছে দাবি, তাকে যেন চাকরিতে বহাল রাখা হয় এবং তার কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয়।

আরেক ছাত্র রমিজ আহমেদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই শফিকুল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছি। স্যার খুবই সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে চাকরিজীবন শুরু করেন। একটা সময় সংসার চালাতে পারতেন না, লেখাপড়া করার খরচ মেটাতে পারতেন না। ফলে তিনি আমাদের ১০০ থেকে ২০০ টাকায় পড়াতেন।

রমিজ আরও বলেন, স্যার গণিতে দক্ষ ছিলেন। দিনে চার-পাঁচটা ব্যাচ পড়াতেন। বাড়ি থেকে টিফিন নিয়ে যেতেন। মাঝেমধ্যে তা নষ্ট হয়ে যেত, কিন্তু অভাবের কারণে সেই নষ্ট খাবারটুকুই খেয়ে ফেলতেন। এসব কারণে এলাকার সবাই তাকে সম্মান করেন। স্যার রেলওয়েতেও সততার সঙ্গে কাজ করেন। গ্রামে যে ভিটাবাড়ি আছে, সেখানে এখনো ভালো একাট ঘর তৈরি করতে পারেননাই। তবে তার ওপর অবিচার করা হয়েছে।

শফিকুলের মা শুকজান নেছা বলেন, আমার ছেলে মানুষের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার, খারাপ কথা বা মারামারি করে মানুষ হয়নি। গ্রামের কোনো মানুষ তাদের খারাপ বলবে, সে সুযোগ দিইনি। আমার ছেলে খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে। শফিকুল লেটারসহ এসএসসি পাস করার পর বিভিন্ন কলেজের স্যাররা আমার ছেলেকে কলেজে নেওয়ার জন্য বাড়িতে আসেন। শেষে চেয়ারম্যানসহ সবাই অনেক অনুরোধ করেন। ছোট থেকেই আমার ছেলে অনেক সৎ।

সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান বলেন, শফিকুল ইসলাম বেশ কয়েক দিন ধরে খবরের আলোচনায়। তিনি নাকি যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। আমরা যতটুকু জানি, তাদের পরিবার দুস্থ। বাড়িতে ঘরদোরের অবস্থা জীর্ণ। তারা মানুষ হিসেবে খুবই ভালো। শফিকুলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটা সঠিক নয়।

তিনি আরও বলেন, একজন মানুষ খারাপ হলে তার বাহ্যিক কিছু নিদর্শন দেখা যায়। এলাকায় আরও অনেকে রেলওয়েতে চাকরি করেন। গত ১০ বছরের মধ্যে তার মতো এত সচ্চরিত্রের লোক পাওয়া খুবই কষ্টের। তিনি টিটিই হওয়ার কারণে প্রতিদিন সরকারি নগদ টাকা (জরিমানা) তার হাত দিয়ে লেনদেন হয়। সেখান থেকে যদি কিছু টাকা সরিয়ে রাখতেন, কেউ ধরতে পারবে? যদি তিনি তার করতেন, তাহলে এলাকায় সেগুলো প্রকাশ পেত। তিন্তু আমরা তেমন কিছুই দেখি না। শফিকুল ইসলামের নামে মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি করা তার জন্য কাম্য নয়।

আমি তিন দফায় টানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে আছি। তিনি নেশা করেন, এমন অভিযোগ মেনে নিতে পারছি না। এসব মিথ্যা। তিনি আসলে খুবই সৎপ্রকৃতির লোক।

রেল নিয়ে শফিকুলের ভাবনা শফিকুলের রেলকে ঘিরে রয়েছে অনেক প্রত্যাশা। নিজের প্রিয় কর্মস্থল ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের নিজ কার্যালয়ে বসে সেই প্রত্যাশার কথাগুলো জানালেন তিনি।

বাবা-মায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত শফিকুল বলেন, ‘আমার বাবা-মা খুবই আদর্শবান। তারা আমাকে সব সময় বলেন-অবৈধ ইনকাম করে এনে গোস্ত-ভাত খাওয়ার চাইতে সৎ ইনকামের ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকা উত্তম। আমি তাদের আদর্শ লালন করেই চলতে চাই।’
শফিকুলের আদর্শের আরেক গুরু ছিলেন তার প্রাইভেট শিক্ষক রবী ঠাকুর।

প্রিয় শিক্ষককে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘বাবা-মায়ের পাশাপাশি আমি একজন শিক্ষক পেয়েছিলাম। তাকেও আমি আমার আদর্শের অন্যতম দিকপাল মনে করি। তিনি আমাদের শুধু প্রাইভেট পড়াতেন। আমি এসএসসি দেওয়ার আগেই তিনি ভারত চলে গেছেন। কিন্তু আমি তার দেওয়া উপদেশ-আদেশ এখনো ধারণ করি।’

কর্মজীবনের শুরুটা ছিল বেশ আনন্দের জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে লালমনিরহাটে রেলস্টেশনে জয়েন করি। পরে ২০১৪ সালে ঈশ্বরদীর পাকশী রেলওয়ে বিভাগে যোগদান করি।’

বিপদ-আপদে অসহায় মানুষের পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা আলোকিত শফিকুলের। তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো বিপদে পড়লে ছুটে চাই। মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমি যখন টিউশনি পড়িয়েছি, তখন অনেককেই বিনা টাকায় পড়িয়েছি। সেসব ছাত্র এখন মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আমি যুক্ত রয়েছি।’ মাদকের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছি, আমার চা পর্যন্ত খুব একটা খাওয়া হয় না, বিড়ি-সিগারেট তো ছুঁয়েও দেখিনি। এ জন্য আমার গ্রামের মানুষগুলোও এখনো আমাকে খুব রেসপেক্ট করে, সম্মান করে।’

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণপরিবহন হলো রেল। লাখ লাখ মানুষ সহজে ও সাশ্রয়ে প্রতিদিন রেলভ্রমণ করেন। ফলে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা রেল। কিন্তু হচ্ছে উল্টো। এটিই শফিকুলকে ভাবায়। দেশব্যাপী আলোচিত শফিউল রেলকে রূপান্তর করতে চান লাভজনক প্রতিষ্ঠানে।

নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার চেষ্টা থাকবে আমার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই।’

ইতোমধ্যেই রেলের রাজস্ব আদায়ে বড় অবদান রাখছেন শফিউল। সম্প্রতি সময়ের রাজস্ব আয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসেই আমি রেল থেকে ২ থেকে ৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করি।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৪০ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫৩০ টাকা, মার্চে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৯০ টাকা এবং সবশেষ এপ্রিলে রাজস্ব আদায় করেছি ৩ লাখ ১ হাজার ২৮০ টাকা।

- Advertisement -

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত