Monday, May 20, 2024

হাজারো আফগান সেনা প্রতিবেশি দেশে

- Advertisement -

সাজোয়াঁ যান, পিকআপ ট্রাকে চড়ে আফগান সেনাদল মরু পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছে ইরানে। সামরিক বাহিনীর বৈমানিকরা নিচু দিয়ে দ্রুত গতিতে উড়ে নিরাপদ অবস্থান খুঁজে নিয়েছে উজবেকিস্তানের পাহাড়ি এলাকায়।
তালেবান দ্রুতগতিতে কাবুল দখল করার মধ্যেই গত কয়েক সপ্তাহে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
বাকিরা তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করে বাড়িতে ফিরে গেছেন। আর একটি অংশ অস্ত্র জমা না দিয়ে বিজয়ী দলে যোগ দিয়েছে।
এরা সবাই আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অংশ ছিল, যে বাহিনীকে গড়ে তুলতে শত শত কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো।
তালেবানের বিরুদ্ধে লড়তে দুই দশক ধরে গড়ে তোলা এই বাহিনীর জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে এই অর্থ খরচ করা হয়েছে। সব শেষ হয়ে গেছে মাত্র অল্প কিছু দিনের মধ্যে।
ওয়াশিংটন যদিও বলে আসছে, আগুয়ান তালেবানের সামনে আফগান বাহিনী হাল ছেড়ে দিয়েছিল, সরকারি সেনাবাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য, কমান্ডো আর গুপ্তচর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন। তাদেরকে দেশেই আটকে থাকতে হয়েছে।
এখন তারাও পালাচ্ছেন, আত্মগোপনে যাচ্ছেন। আর তালেবান তাদের খুঁজছে।
রণাঙ্গণের এক সময়ের সঙ্গী এক মার্কিন সেনাকে পাঠানো একটি টেক্সট মেসেজে এক আফগান কমান্ডো ফরিদ লিখেছেন, “পালানোর পথ পাচ্ছি না।”
শুধু নামের প্রথম অংশ প্রকাশ করতে রাজি হওয়া ফরিদ জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের পূর্বাংশে পার্বত্য এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। তার সঙ্গের আফগান সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করায় এখন তিনি যেন ফাঁদে আটকা পড়ে গেছেন। লিখেছেন “উদ্ধার পাওয়ার জন্য দোয়া পড়ে যাচ্ছি আমি।”
যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো বাহিনীর সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করেছে বা তাদের সঙ্গে কাজ করেছে এমন আফগানদের খুঁজে বের করছে তালেবান।
জাতিসংঘের জন্য প্রস্তুত করা একটি গোপনীয় প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সাবেক একজন আফগান কর্মকর্তা বলেছেন, তালেবান যাদের খুঁজছে, তাদের না পাওয়া গেলে ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার বা শাস্তি দেওয়ার হুমকিও দিচ্ছে।
যুদ্ধফেরত মার্কিন সেনারাও একই ধরনের কথা বলেছেন, যারা রণাঙ্গনের পুরনো সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে নিরুপায় বার্তা পাচ্ছেন।
সেই মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তালেবান সদস্যরা আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর (এনডিএস) সদরপ্তরে রক্ষিত নথিপত্রে চিরুণি অনুসন্ধান চালাচ্ছে, এবং আফগানদের খোঁজার জন্য তালিকা তৈরি করছে।
আমেরিকান স্পেশাল ফোর্সের জন্য কাজ করা সাবেক এক দোভাষী বলেছেন, তার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে গুলি করে মারা হয়েছে এই সন্দেহে যে, ওই ব্যক্তি বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছিল।
আফগানিস্তানের দক্ষিণের শহর কান্দাহারে গত সপ্তাহে সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম-আরটিএতে প্রচারিত একটি ভিডিওতে রাস্তার ধারে বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, যাদের অনেকেই আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও কর্মকর্তা ছিলেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। আরটিএর নিয়ন্ত্রণও এখন তালেবানের হাতে।
কত সংখ্যক আফগান সেনা ও নিরাপত্তা কর্মী পালানোর চেষ্টায় আছেন, তা স্পষ্ট নয়। রোববারও বেশ কিছু আফগান পাইলট পালিয়ে উজবেকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে ২২টি বিমান ও ২৪টি হেলিকপ্টারে প্রায় ৬০০ লোককে নেওয়া হয়েছে। উজবেক কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন; এছাড়া আফগান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানে আশ্রয় নিয়েছে আরও বহু সংখ্যক আফগান সেনা।
কাগজে-কলমে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীতে সদস্য ছিল প্রায় তিন লাখ। কিন্তু দুর্নীতি, বাহিনী ছেড়ে যাওয়া এবং হতাহতের কারণে এ বছর এর ছয় ভাগের মাত্র এক ভাগ তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ভাষ্য।
দেশজুড়ে তালেবান বাহিনীর অগ্রযাত্রার সময় হাজার হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করে তাদের অস্ত্র জমা দিয়েছে এই আশ্বাসে যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।
এখন পর্যন্ত তালেবান তাদের ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছে। অতীতেও আফগান লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা দেখা গেছে।
দেখা যাচ্ছে, তালেবানের লক্ষ্য মূলত সেনা কমান্ডো বাহিনীর ১৮ হাজার সদস্যকে খুঁজে বের করা, যাদের অনেকেই আত্মসমর্পণ করেননি। তাছাড়া আফগানিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মী, জাতীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের সদস্যদেরও খোঁজা হচ্ছে।
তাদের একটি অংশ কাবুলের উত্তরে পাঞ্জশির উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছে, যেখানে হাতেগোনা কয়েকজন আফগান নেতা তালেবানকে প্রতিরোধ করতে একটি বাহিনী গড়ার চেষ্টা করছেন।
সেখানে দুই থেকে আড়াই হাজার যোদ্ধা অবস্থান নিয়ে আছে বলে দাবি করা হলেও নিরপেক্ষভাবে এর সত্যতা যাচাই করতে পারেনি নিউ ইয়র্ক টাইমস।
দুই দশক আগে, এই পঞ্জশিরেই মুজাহিদিন নেতা আহমেদ শাহ মাসুদ তালেবানের বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরে প্রতিরোধ টিকিয়ে রেখেছিলেন। নাইন ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার কয়েক মাস পর তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এই অঞ্চলকেই যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা বাহিনীর ‘লঞ্চপ্যাড’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু এবার পাঞ্জশিরে ভারি অস্ত্র নেই, নেই আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্ত থেকে রসদ সরবরাহের সুযোগ, বা মাসুদের মতো একজন নেতা, যিনি ঐক্য গড়ে তুলতে পারেন।
এমনকি যেসব আফগান তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তারাও এই প্রতিরোধকারীদের সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান।
আফগানিস্তানের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানান, কাবুল বিমানবন্দরে, এনডিএসের কয়েকশ কমান্ডো কয়েক হাজার মার্কিন সেনাকে বিদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুসারে কাবুল থেকে সবশেষে সরিয়ে নেওয়া হবে আফগানদের, যারা স্বাধীনতা পাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পেছনের দরজার পাহারাদারের মতো কাজ করে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা বলেন, “তারা সাহসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।” অবশ্য আরেকজনের ভাষায়, “এটা কম করে বলা হচ্ছে।”
এনডিএস কমান্ডোদের আতঙ্কিত হয়ে পড়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। এই ইউনিটের সদস্যরা যুদ্ধের ময়দানে অসংখ্য তালেবান যোদ্ধা ও কমান্ডারকে হত্যা করেছে- এসব মৃত্যুর বদলা নিতে চায় তালেবান।
গত রোববার কাবুল দখল করার পর তালেবান সদস্যরা আফগানিস্তানের জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিতে শুরু করে।
সাবেক একজন আফগান কর্মকর্তা জানান, তালেবান সদস্যরা এনডিএসের একজন সাবেক প্রধান রহমাতুল্লাহ নাবিলের বাড়িতে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিসহ গিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে। নাবিল সম্প্রতি দেশ ছেড়ে গেছেন।
সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনীর আরেকজন কর্মকর্তার অ্যাপার্টমেন্টে তালেবানের পক্ষ থেকে একটি চিঠি রেখে আসা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, তাকে কাবুলে তালেবানের সামরিক ও গোয়েন্দা কমিশনের সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। চিঠির অনুলিপি জাতিসংঘের গোপনীয় প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে।
আফগান সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনীর কর্মকর্তারাই কমান্ডোদের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, যারা তালেবান নেতাদের খুঁজে বের করত। ওই চিঠিতে লেখা হয়েছে, “ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান আপনাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করে।”
সেখানে হুমকি দেওয়া হয়েছে, যদি ওই কর্মকর্তা তালেবানের নির্দেশ মেনে দেখা না করেন, তাহলে তার পরিবারকে আটক করা ও শাস্তি দেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহকারী একটি গোষ্ঠী- নরওয়েজিয়ান সেন্টার ফর গ্লোবাল অ্যানালাইসেস জাতিসংঘের কাছে এই নথি দিয়েছে। জাতিসংঘের অভ্যন্তরে এই নথি চালাচালি হয়েছে এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস সেটা দেখেছে।
নথিতে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করতে ও শাস্তি দিতে চায় এমন লোকদের এবং তাদের অবস্থানের একটি তালিকা তালেবানের রয়েছে বলে একাধিক সূত্র থেকে খবর পাওয়া গেছে।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, এদের খোঁজে তালেবান বাড়ি বাড়ি লোক পাঠাচ্ছে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা বা গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, যদি না তারা আত্মসমর্পণ করেন।
ওই প্রতিবেদন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, তালেবান নেতৃত্ব আগ্রাসীভাবে তাদের তথ্যদাতাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করছে এবং মসজিদের কর্মী ও হাওয়ালা লেনদেনকারীদের চাপ দিচ্ছে, যাতে তারা ওইসব লোকদের খুঁজে বের করতে তালেবানকে সহযোগিতা করে।
নথিতে বলা হয়, তালেবানের মূল টার্গেট হচ্ছে আফগান সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, পাশাপাশি যারা উৎখাত হওয়া সরকারের তদন্ত ইউনিটে কাজ করত।
পেন্টাগনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের সরিয়ে আনা হবে, যদি তারা কাবুল বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন। কিন্তু তাদের কোথায় নেওয়া হবে তা স্পষ্ট নয়। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ ভিসা কর্মসূচিরও আওতাভুক্ত নন।
সূত্র: বিডিনিউজ

- Advertisement -

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত