যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে শ্যোন অ্যারেস্ট হওয়া আট কিশোরের মধ্যে চারজন ছিল দীর্ঘদিনের বন্দি। তারা প্রত্যেকেই হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২০১৫ সাল থেকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি রয়েছে। দীর্ঘদিন থাকায় চলাফেরা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। কর্তৃপক্ষের কাছেও ছিল তাদের বাড়তি সম্মান। তারা যা বলতো সেটিই হতো শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। নতুন বন্দিদের দিয়ে সব ধরনের কাজ করতো তারা। ট্রিপল মার্ডারের পর যশোরে হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, যশোর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, আটক চার আসামির স্ব স্ব এলাকার থানাসহ বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে তাদের অপরাধের কাহিনী জানাগেছে। যা গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কিশোর বন্দি রিফাত। সে ছোট থেকেই বেপরোয়া ছিল। কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার ভেলাকোপা গ্রামের রফিকুল ইসলামের ছেলে সে। নিজ এলাকার সকলের কাছে সে পিচ্চি সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। কুড়িগ্রাম রিভারভিউ স্কুলে পড়া অবস্থায় সরদারপাড়ার ব্যবসায়ী সুলতান আহম্মেদের একমাত্র ছেলে কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আলিফ আহম্মেদ স্বপ্ন তার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। ‘ টাকার লোভে ঘনিষ্ট বন্ধুকে হত্যা করতে পিছুপা হয়নি এই রিফাত। মুক্তিপণের আশায় ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর সকালে নিজ বাড়িতে ডেকে আনে বন্ধু স্বপ্নকে। ইচ্ছে ছিল মুক্তিপণ আদায় করা। কিন্তু স্বপ্নের চিৎকারে আশপাশের লোক জানাজানির ভয়ে আরেক বন্ধু আকাশের সহযোগিতায় মাফলার দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে স্বপ্নকে। রিফাতের বাসার সেফটিকট্যাংকি থেকে স্বপ্নের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রিফাত ও তার মা মোর্শেদাকে পুলিশ আটক করে। যা আদালতে স্বীকারও করে রিফাত। এরপর তার মাকে কুড়িগ্রাম কারাগার ও রিফাতকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তখন থেকেই সে এখানেই আটক রয়েছে। আটক আটজনের মধ্যে আরেকজন নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার মুক্তার হোসেনের ছেলে হুমাইদ হোসেন। সেও ২০১৫ সাল থেকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রয়েছে। নাটোরের চাঞ্চল্যকর মাদ্রাসাছাত্র তানভির আহম্মেদ (১১) হত্যা ও মরদেহ গুম করার দায়ে তিন যুবককে বিভিন্ন মেয়াদে আটকাদেশ দিয়েছেন আদালত। তার মধ্যে সেও একজন। নিহত তানভির শহরের উত্তরবড়গাছা (হাফরাস্তা) এলাকার সাইফুল ইসলাম তুষারের ছেলে। সে শহরের আলাইপুর এলাকার আশরাফুল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিল। ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট বিকেলে মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হয় তানভির আহম্মেদ। বিষয়টি জানার পর আত্মীয় স্বজন বিভিন্নস্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান না পেয়ে বাবা সাইফুল ইসলাম তুষার ২৬ আগস্ট নাটোর সদর থানায় সাধারণ ডায়রি করেন এবং র্যাবকেও বিষয়টি জানান। একপর্যায়ে র্যাবের একটি অপারেশন দল মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে বায়েজিদ, হুমাইদ ও নাঈম নামে তিন কিশোরকে আটক করে। তারা র্যাবের কাছে তানভিরকে অপহরণ করে হত্যার কথা স্বীকার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যমতে র্যাব পহেলা সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে ওই মাদ্রাসার পিছনের একটি সেফটিক ট্যাংক থেকে তানভীরের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় নিহত তানভীরের বাবা সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে ওইদিন সন্ধ্যার দিকে নাটোর সদর থানায় ওই তিন কিশোরকে অভিযুক্ত করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) সুকমল দেবনাথ তদন্ত শেষে একই বছরের ২৫ অক্টোবর আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও তথ্য প্রমাণ শেষে পরের বছর ১০ জুলাই নাটোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মাইনুল হক হুমাইদ হোসেনকে পৃথক তিন ধারায় মোট ১৮ বছরের আটকাদেশ দেন। পরে তাকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সে সময় থেকেই যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তার অবস্থান। রিফাতের এখন ঘনিষ্ট বন্ধ হিসেবে রয়েছে সে।আটক পুরানো চার আসামির মধ্যে অপর দু’জনও একই মামলার আসামি। তারা হচ্ছে, পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে মনোয়ার ও একই এলাকার কুদ্দুসের ছেলে ইমরান। তারাও ২০১৫ সাল থেকে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি হিসেবে আছে। মনোয়ার ও ইমরান পাবনার বেড়া পৌর এলাকার স্যানালপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আব্দুল মাজেদের ছোট ছেলে আরাফাত হোসেন কে ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে মুক্তিপণের দাবিতে প্রথমে অপহরণ করে। এরপর দাবি করে ১৬ লাখ টাকা। মুক্তিপণের টাকা না পওয়ায় পরদিন ২২ আগস্ট দুপুরে বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পিছনের একটি জঙ্গল থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় শিশু আরাফাতকে উদ্ধার করে বেড়া থানা পুলিশ। তাকে প্রথমে বেড়া হাসপাতাল, পরে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর হাসপাতাল, এরপর বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন চিকিৎসকরা। উদ্ধারের ১৫ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আরাফাতের বাবা আব্দুল মাজেদ বাদী হয়ে ২৬ আগস্ট বেড়া থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে অপহরণ মামলা করেন। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করে। তারা সবাই আদালতে ঘটনার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়। ওই চারজনের মধ্যে তারা দু’জন।এদিকে, যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর হত্যা মামলার আট আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্টের পর সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা চাঁচড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ রোকিবুজ্জামান।আদালত সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার আট আসামির রিমান্ড আবেদন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। যা আগামী রোববার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-১ এর বিচারক টিএম মুসার আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
বিশেষ প্রতিনিধি