এদিকে আনসার উদ্দিন হত্যার ঘটনায় গতকাল শনিবার দিনগত গভীর রাতে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। বারাকপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও গাজী জাকির হোসেনের ভাইয়ের ছেলে গাজী সগীর হোসেনকে মামলার প্রধান আসামি করে মোট ২৩ জনের নাম ও অজ্ঞাতনামা ৭ থেকে ৮ জনকে ওই মামলার আসামি করা হয়েছে।
খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন বলেন, মামলার এজাহারভুক্ত দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার এবং সন্দেহভাজন হিসেবে একজনকে আটক করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
প্রাথমিকভাবে পূর্বশত্রুতার জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে আনসার উদ্দিনের একমাত্র ছেলে ও মামলার বাদী শেখ তানভীর বলেন, স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে পূর্বশত্রুতার জেরে তাঁর বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের স্বজনেরা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করছেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বারাকপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান গাজী সগীর হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, দিঘলিয়া উপজেলার লাখোহাটির প্রভাবশালী ‘চার বাড়ি’ পরিবারের সন্তান আনসার শেখ। তবে দীর্ঘকাল ধরে থাকতেন বারাকপুর গ্রামে। তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য। অবসর গ্রহণের পর এলাকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃত্ত করেন। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। বারাকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদও পান। এরপর প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়ান ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা গাজী জাকির হোসেনের পরিবারের সঙ্গে। বাজার কমিটির নির্বাচন, ইউপি নির্বাচন সব দ্বন্দ্বেই উঠে আসে তাঁর নাম। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার অধিকারীর রাজনৈতিক কর্মী বলে এলাকায় পরিচিত আনসার উদ্দিন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের শুরুর দিকে বারাকপুর বাজার কমিটির নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ আনসার। ওই বছরই করোনাকালীন চাল দেওয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে বারাকপুর বাজারে চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনকে আনসারের লোকজন লাঞ্ছিত করেন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ ফাঁকা গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। একই বছর চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে স্থানীয় নারীরা মানববন্ধন করেন। এসবের পেছনে আনসারের হাত ছিল বলে জাকির গাজীর স্বজনেরা অভিযোগ তোলেন।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বারাকপুর ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আনসার উদ্দিন। সেই সময় অল্প ভোটের ব্যবধানে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী গাজী জাকিরের কাছে পরাজিত হন। ভোটের আগে প্রচারণার সময় দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক দফায় সংঘর্ষ বাঁধে। ভোটের দিন দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থল থেকে আটটি ককটেল উদ্ধার করে পুলিশ। নির্বাচনের পর থেকে দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েকবার ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এরপর ২০২২ সালে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন। নিহত হওয়ার পর ওই বছরের নভেম্বরে উপ-নির্বাচনে শেখ আনসার উদ্দিন আবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। তবে ঋণখেলাপির অভিযোগে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। গাজী জাকির হত্যা মামলায় আনসার উদ্দিন সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করেন নিহত জাকিরের পরিবার।
আনসার উদ্দিনের ছেলে শেখ তানভীর বলেন, ‘বাইরে বাবার কোনো শত্রু নেই। এলাকায়ই তাঁর শত্রু আছে। সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের ভাতিজা বর্তমান চেয়ারম্যান পাভেল গাজী (গাজী সগীর হোসেন) এর সঙ্গে জড়িত। বারাকপুর বাজার কমিটির নির্বাচন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে যে দ্বন্দ তৈরি হয় সেই কারণেই এই ঘটনা তাঁরা ঘটিয়েছে বলে মনে করছি। আগের শুক্রবারে আব্বা বারাকপুরে গেলে তাঁকে হুমকি ধামকি ও ধাওয়া দিয়েছিল ওরা। আমাদের বারাকপুর বাজারে কাপড়ের ব্যবসা ছিল। গাজীরা আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করেছে। বাড়িতে বোমা মেরেছে। নির্বাচনের সময় আমাদের কর্মীদের ওপর আক্রমণ করেছে। গাজী জাকির হত্যা মামলায় বাবাকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে জড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের বাড়ি ছাড়া করেছে। পূর্বশত্রুতার জেরে এই হত্যাকাণ্ডও ঘটিয়েছে।’
দিঘলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিপন কুমার বলেন, চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন হত্যাসহ শেখ আনসার উদ্দিনের বিরুদ্ধে দিঘলিয়া থানায় সাতটি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো থেকে তিনি জামিনে ছিলেন। মামলাগুলো মূলত ২০২০ সালের পরই হয়েছে। আর সব কটি মামলা মোটামুটি গাজী জাকির হোসেন ও তাঁর স্বজন বা সমর্থকদের করা।
খুলনা প্রতিনিধি