ভিসা জটিলতায় বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে ভারতগামী যাত্রীর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে ।
ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় কমেছে দু’দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার।আগে প্রতিদিন যেখানে ৭থেকে ৯ হাজার যাত্রী পারপার হত,এখন সেখানে প্রতিদিন পারাপার হচ্ছে ৪ হাজার যাত্রী।যাত্রী পারাপার কমে যাওয়ায় ‘ভ্রমনকর’ বাবদ রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে।৫ অগাস্টের পর থেকে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছেন,বছরে এ বন্দরে ভ্রমণ কর থেকে রাজস্ব আদায় হয় ১৮২ কোটি টাকা। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হত। বর্তমানে রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা।
বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলেছেন, মঙ্গলবার বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ৪০৪৫জন যাত্রী পারাপার হয়েছে,এর মধ্যে ভারতে গেছে ১৮৮৮ জন,এসেছে ২১২৭ জন।বুধবার ৫২৩১ জন যাত্রী পারাপার হয়েছে,এর মধ্যে ভারতে গেছে ২৬০২ জন,এসেছে ২৬২৯ জন।বৃহস্পতিবার পারাপার হয়েছে ৫১৫৯ জন,এর মধ্যে ভারতে গেছে ২৬৫১ জন,এসেছে ২৫০৮জন।
স্থলপথে পারাপারের জন্য দেশের সবচাইতে বড় আন্তজার্তিক চেকপোস্ট হচ্ছে বেনাপোল চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ৭থেকে ৯ হাজার যাত্রী পাসপোর্ট যাত্রী যাতায়াত করে থাকে। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব ৮৪ কিলোমিটার।দূরত্ব কম ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় অধিকাংশ যাত্রী এই পথেই ভারত যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এপথে ব্যবসা, ভ্রমন(পর্যটন) ও মেডিকেল ভিসার যাত্রীর সংখ্যা সবচাইতে বেশি।ভিসা বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা।
ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। তাতে পর্যটন বা বিভিন্ন কাজে যারা ভারতে যাতায়াত করতেন,তারা পড়েছেন বিপাকে।পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল বেনাপোলের মানিচেঞ্জার,স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও চরম দুঃসময় পার করছে।
এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভারত ভিসা কার্যক্রম সীমিত করে রাখায় বড় ধরনের ব্যবসায় ধস লেগেছে বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্টের বিভিন্ন ব্যবসায়।
বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্টে দিয়ে ভারত বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশের যাতায়াতকারি পর্যটকদের সহযোগিতার জন্য সীমান্তে গড়ে উঠেছে নানা প্রতিষ্ঠান।এখানে মানিচেঞ্জার থেকে শুরু করে দূরপাল্লার পরিবহন কাউন্টার,ট্যুর গাইড,ভিসা সহায়তা কেন্দ্র, বাস ট্রেন প্লেনের টিকেট বুকিং এজেন্সি এবং হোটেল,রেস্তোরাঁসহ ছোটখাটো নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বেনাপোল চেকপোস্টে এলাকায়।
বেনাপোল সোহাগ পরিবহনের স্থানীয় অফিস ব্যবস্থাপক শহিদুল ইসলাম বলেন,যাত্রী না থাকায় পরিবহন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। আগে যেখানে প্রতিদিন বেনাপোল থেকে দেড়শ দূরপাল্লার (পরিবহন)বাস বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উদ্দেশে ছেড়ে যেত। এখন সেখানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টা বাস ছেড়ে যাচ্ছে।তারপরও পরিবহনের অধিকাংশ বাসই খালি যাচ্ছে।পরিবহন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই কোম্পানির মালিকরা লসের টাকা মাথায় নিয়েই পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতীয় ‘ভ্রমন ভিসা’ প্রদান শুরু না হলে খুব শিগগিরি পরিবহন ব্যবসা বেনাপোল থেকে গুটিয়ে নিতে হবে বলে তিনি জানান।
চেকপোস্টের রাজা-বাদশা মানি চেঞ্জার এর মালিক আবুল বাশার বলেন,আমরা সাধারণত এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যবসায়ী ও ভারত যাতায়াতকারি পাসপোর্ট যাত্রীদের টাকা এক্সচেঞ্জ করে থাকি।এদের যাতায়াত কমে গেলে আমাদের কাজও কমে যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আমরা একেবারেই হাতগুটিয়ে বসে আছি।আয় রোজগার না হলেও অফিস খরচ, নিজেদের হাত খরচ,কর্মচারি বেতন তো হয়েই যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পথে বসতে হবে।
চেকপোস্টের ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বলেন,চেকপোস্ট এলাকায় অন্তত চার শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে।যারা শুধুমাত্র পাসপোর্ট যাত্রীদের উপর নির্ভরশীল।স্থানীয়রা খুববেশি পণ্য কিনতে এখানে আসে না।পাসপোর্ট যাত্রী কমে যাওয়ায় অনেকের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ডিরেক্টর মতিয়ার রহমান বলেন,ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে।ব্যবসা ও ভ্রমন ভিসার যাত্রীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ভিসা বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়েছেন তারা। ভারত সরকার ব্যবসা (বিজনেস) ভিসা না দেওয়ায় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
একজন আমদানি রপ্তানিকারক আবু নিদাল ফয়সল জানান,প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তা ক্রয় করার আগে ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে যেয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য পছন্দ করে কিনে থাকেন তারা। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে এখন তারা এ কাজ করতে পারছেন না। ফলে অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ভারত যাতায়াতকারী পাসপোর্ট-যাত্রীরা জানান,আমরা ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারতে যাচ্ছি। ভারতীয় মেডিকেল ভিসা পেতেও আমাদের দুই থেকে তিন মাস সময় লাগছে। আগেও বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে গেছি কিন্তু চেকপোস্টের এমন চিত্র কখনো দেখিনি। চেকপোস্ট একদম ফাঁকা। আমরা কয়েকজন ছাড়া ভারতে যাওয়ার কোন যাত্রী নাই। ভারত সরকার বাংলাদেশীদের জন্য টুরিস্ট ভিসা প্রদান বন্ধ রাখার কারণেই হয়তো চেকপোস্টে কোন যাত্রী নেই বলে তারা জানান।
বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশন ওসি ইমতিয়াজ মোঃ আহসানুল কাদের ভূইয়া সাংবাদিকদের বলেন,বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে পূর্বে ৭ থেকে ৯ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতেন। ৫ আগস্টের পর যাত্রী সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ভিসা না দেওয়ার পর যাত্রী সংখ্যা নেই বললেই চলে।
নতুন করে টুরিস্ট ভিসা চালু না করলে আগামী এক মাসের মাসের মধ্যে দু’দেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার শুন্যের কোটায় নেমে আসবে।
রাতদিন সংবাদ