প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এর বড় পরিচয় হওয়ার কথা ছিল। কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, যেটির ওপর ভিত্তি করে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি ছাপিয়ে জেলাটির পরিচয় এখন ইয়াবা–বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার, মানব পাচারের সূতিকাগার ও এককভাবে সর্বোচ্চসংখ্যা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া জেলা হিসেবে। অপরাধের যত রকম খারাপ চেহারা আছে, সবই বিদ্যমান ওই জেলায়। কিন্তু সব অপরাধের সঙ্গে পুলিশ যুক্ত, সব পুলিশই যে অপরাধ করেছেন—এভাবে সরলীকরণের একটি সুযোগ করে দেওয়া হলো।অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে, একটি জেলার সব পুলিশ সদস্যকে গণবদলি করা হয়েছে। বাহিনীতে জেলার সর্বোচ্চ পদ পুলিশ সুপার, তিনিও নেই। সর্বনিম্ন পদ কনস্টেবল—তাঁদের সবাইকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।কক্সবাজারের সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করতে সবাই সোচ্চার। বিতর্কিত ওসি প্রদীপ দাশসহ অভিযুক্ত সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। ঘটনার পর আইনি প্রক্রিয়া ও বিচারিক ব্যবস্থা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন ওঠেনি। এরই মধ্যে গোটা জেলার সব পুলিশকে সরিয়ে দেওয়ায় ডালপালা মেলেছে অনেকগুলো প্রশ্ন।এসব পুলিশ তো বাহিনীতেই থাকবেন, অন্য কোনো জেলা বা মহানগর হবে তাঁদের কর্মস্থল। তাহলে কক্সবাজার থেকে সরিয়ে লাভটা কী হলো? তাঁরা যদি অন্যায় করে থাকেন, তাঁরা যদি নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে যান তাহলে অন্যত্র গিয়ে কি সাহস ও মনোবল ফিরে পাবেন?প্রশ্ন ওঠে—তাঁদের সরানোর আগে নির্মোহ পর্যালোচনা কতটা হয়েছে? পুলিশ বাহিনী কি সত্যিকার অর্থে মনে করে, সবাইকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল? তাতেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে?আবার যদি কোনো অভিযোগের কারণে তাঁদের সরানো হয়, তাহলে বদলিটাই সমাধান নয়। সে ক্ষেত্রে তদন্ত ও শাস্তি কাম্য। কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে এত দিন যা জানানো হয়েছিল, তা রাতারাতি অসত্য প্রমাণিত হলো। বলা হচ্ছিল, সেখানে পুলিশ অপরাধীদের মধ্যে ভীতির উদ্রেক করতে পেরেছিল, মাদক কারবার ও মানব পাচার কমে এসেছিল। করোনাকালে কক্সবাজার পুলিশের সদস্যদের অনেকে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস ওই জেলায়, যাদের নানামুখী অপরাধপ্রবণতা রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে—একটি হত্যাকাণ্ডে সবকিছুই কি মিথ্যা হয়ে গেল? আর অপরাধ যদি হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে কি শুধু পুলিশই অপরাধ করেছে? সরকারের অন্যান্য বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান এবং জনপ্রতিনিধিরা তাহলে কী করেছেন? স্থানীয় এক সাংসদের স্বামীর বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারির অভিযোগ বহু পুরোনো, তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলমান।কক্সবাজারে চাকরি করার কারণে এখন অনেকে বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়বেন। তাঁদের দিকে আঙুল তুলে বলা হবে, ওই সময় তো কক্সবাজারে চাকরি করেছেন, গণবদলিতে পড়েছিলেন। দেশে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার পর বাহিনীর নাম পাল্টে ফেলাসহ বড় ধরনের ওলট-পালট করা হয়েছিল। এখানে পরিধিটা কম, কিন্তু ধরনটা একই রকম।কক্সবাজার জেলায় আটটি থানা, একাধিক পুলিশ ফাঁড়ি, আদালত, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও ট্রাফিক বিভাগে এসব পুলিশ কর্মরত ছিলেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির হওয়ায় সেখানে চুরি-ডাকাতি, ইয়াবা কেনাবেচা, মানব পাচার—সবই তো হয়। কিন্তু একটি জেলা থেকে একযোগে সব পুলিশ সরিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক কারণ ব্যাখ্যা করেনি পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্য থেকে ধারণা পাওয়া যায়, সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতেই পর্যায়ক্রমে এই রদবদল।এ সিদ্ধান্তের ফলে পুলিশের অন্তত ১ হাজার ৪৮৭ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলকে জেলা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে, সেখানে নতুন যোগ দেবেন ১ হাজার ৫০৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলা পুলিশকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। ইতিপূর্বে যাঁরা কর্মরত ছিলেন তাঁরা ভালো কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করার জন্য ‘টোটাল চেঞ্জ’ করা হয়েছে। তাঁর এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে ভারসাম্যপূর্ণ। কিন্তু এই বক্তব্যের মাধ্যমে এমন গণবদলির ঘটনা ও কারণ ঢেকে দেওয়া যায় না।প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচার, সমুন্নত হবে সংবিধানস্বীকৃত মানবাধিকারের—এটাই হোক কক্সবাজারের শিক্ষা।
অনলাইন ডেস্ক