Wednesday, September 18, 2024

ধূসর শহর, সোনালি স্মৃতি মনে পড়ে যাই

- Advertisement -

৩৩ বছর আগে লেখা আমার শহর কাব্যে সৈয়দ শামসুল হক প্রিয় ঢাকা শহরে এক মুগ্ধ নাগরিকের অভিষেক অঙ্কন করেছিলেন এভাবেই। বছর তেরোতে ১৯৪৮ সালের মার্চে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে যে কবি-কিশোরের আগমন, তিনি ক্রমে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, সংগীত, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য— সর্বশিল্প ক্ষেত্রে অনন্য অর্জনের মধ্য দিয়ে ‘সব্যসাচী’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন; ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এই ঢাকার বুকেই শেষবার শ্বাস নিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক; প্রায় সাত দশক এই শহরে অবস্থানের তাপ ও হিমকে তিনি তাঁর অক্ষরফুলে স্মৃতিসুবাসিত করে রেখেছেন ২৫ বছরের ব্যবধানে রচিত কাব্য আমার শহর (রচনা ১৯৮৭, রফিকুন নবীর অলংকরণে নতুন প্রকাশ: প্রথমা, ২০১৯) এবং আত্মজীবনীর পর্ব তিন পয়সার জ্যোছনায় (রচনা ২০১৩, গ্রন্থাকারে প্রকাশ: প্রথমা, ২০১৪)

‘কেউ কেউ বলে

অই যে দূরের দূরে একসার বাড়ি, অই যে দরোজা সব,

পর্দা ওড়ে পতাকার মতো,

ওখানে সবাই আছে।

চলো হে সৈয়দ হক,

চলো যাই,

আবার জমাই।’

একদা এক রাজ্যে থেকে যাঁর দীপ্ত যাত্রা, তিনি তাঁর কাব্য বৈশাখে রচিত পঙ্‌ক্তিমালা পরানের গহীন ভিতর; উপন্যাস খেলারাম খেলে যা, দূরত্ব, নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, আনারকলি, যেকোনো দরজা (১৯৬১ সালের অগ্রন্থিত উপন্যাসটি সৈয়দ শামসুল হকের প্রয়াণবার্ষিকীতে আজই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো প্রথমা প্রকাশন থেকে); গল্পগ্রন্থ রক্তগোলাপ আনন্দের মৃত্যু; নাটক নূরলদীনের সারাজীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ঈর্ষা; মুক্তগদ্যগ্রন্থ মার্জিনে মন্তব্য, কথা সামান্যই, হৃৎকলমের টানে কিংবা আত্মজৈবনিক আখ্যান প্রণীত জীবন, তিন পয়সার জ্যোছনা হে বৃদ্ধ সময়—এ বাংলা ও বিশ্বের নানা নগরগ্রামের চিত্র আমাদের উপহার দিয়েছেন। তবে এসবের মধ্যে বিশিষ্টতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘ঢাকা’ নামের এক মায়াবী শহর।আমার শহর শুধু কাব্যকথা নয়, যেন এক স্মৃতিচিত্রশালা। এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশ্বস্ত আলোছায়াঘর। এই কাব্য পড়তে পড়তে দেখা যাবে, ওই তো হাসান হাফিজুর রহমান একুশের সংকলন হাতে বেরোচ্ছেন মোহাম্মদ সুলতানের পুঁথিপত্র প্রেস থেকে। ঈদ ও জন্মাষ্টমী মিছিল বেরোচ্ছে, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনাগান হচ্ছে, আরমানিটোলা চার্চের ঘণ্টা বাজছে সমন্বয়ী সংস্কৃতির ঢাকায়। বিউটি বোর্ডিং-ক্যাপিটাল-গোবিন্দধাম-রেক্স-মতিভাই রেস্তোরাঁ কি মধুর ক্যানটিনের চা-শিঙাড়া-চপ-কাটলেট-কাবাব-পরোটা কিংবা লায়নের গলিতে স্বর্গস্বাদের গেলাসি এবং বেশুমার আড্ডার গন্ধ নাকে এসে লাগছে। ব্রিটানিয়া হল থেকে গ্রেগরি পেক, আভা গার্ডনার কিংবা লরেন্স অলিভিয়ারের অভিনয়ে অতীত জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে। জয়নুল-আমিনুল-কাইয়ুম-কিবরিয়া কিংবা মুর্তজা বশীর রেখা ও রঙে বাড়িয়ে চলেছেন আমাদের চিত্তের চিত্রপরিসর। ওই তো লক্ষ্মীবাজারের বাসা থেকে সৈয়দ হক বেরোচ্ছেন; আশেক লেনের মুখে দিনে দেখা হচ্ছে শামসুর রাহমানের সঙ্গে, মাঝরাতে বাড়ি ফেরার পথে ভূত তাড়ানোর মন্ত্রের মতো এলিয়ট আওড়াতে শুনছেন শহীদ কাদরীকে। অগত্যা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ফজলে লোহানী, চিত্রালী হাতে এস এম পারভেজ, রেডিও থেকে ধ্বনিত হচ্ছে লায়লা আরজুমান্দের সুর, গওহর জামিলের নৃত্যনাট্যের বিভা এসে লাগছে অসুর সময়ের গায়ে, কেন্দ্রীয় কারাগারে মুনীর চৌধুরীর কবর রচনার চিরজীবী মুহূর্ত ভেসে আসছে, দাঙ্গার রক্তে আর দুঃখের ধারাতে ভেসে যাচ্ছে ‘ঢাকা নামে নগরীর ফোরাতের তীর’ আর নতুন কারবালার মর্সিয়া ছেড়ে মুক্তির তালাশে মানুষ ভিড় করছে ৩২ নম্বর সড়কের স্বাধীনতাখচিত মুজিববাড়িতে।কবি দেখে চলেছেন শহর এখন কংক্রিটের জঙ্গল, ‘কার্বন মনোক্সাইডের ধোঁয়ায় অস্পষ্ট আজ আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডল, দখলদারের কবজায় আজ শহরের শান্ত সীমান্ত সব নদীর বিভূতি।শহরের পাকস্থলীতে তবু স্মৃতিবাহক কবি শুনতে পান সময়-মানুষের পায়ের আওয়াজ, তার সত্যকার স্বর। তাই শুরুতে যদিও কবি বলেন, ‘এখন আমার কাছে এ শহর বড় বেশি ধূসর/ ধূসর বলে মনে হয়’। কাব্যের শেষে তাই তাঁর আশায় বসতি-স্বর‘কে বলে ধূসর? আমি জানি উজ্জ্বল, অমল, ধবল, ধৌত, আমার এ শহর।জীবনের অস্তবেলায় যেন সায়াহ্নযূথিকার মতো, তিন পয়সার জ্যোছনা  শিরোনামে আত্মকথার এক বিশেষ পর্ব রচনা করেন সৈয়দ হক, যেখানে শহর ঢাকা তাঁর শিল্পযৌবনেরই মতো এক বলীয়ান চরিত্র। একটি শহর তার কবির কল্পনা, বাস্তব ও রচনায় শেষ পর্যন্ত তার বিধিবদ্ধ সীমানা ছাপিয়ে হয়ে ওঠে কতটা মহীয়ান মেট্রোপলিটন; তার স্বর্ণসাক্ষ্য হয়ে রইল এই বই।প্রথম পদার্পণের ক্ষণটি যেন অনুভব করা যায় কবির কলমের সঙ্গে সহযাত্রী হয়েই—ঢাকা! আটচল্লিশের মার্চ মাসের তিরিশ কি একত্রিশে। সেই ফুলবাড়িয়া! ছোট্ট সেই লাল রঙের ইস্টিশন! বাইরে তখনকার ঢাকার প্রসিদ্ধ জনবাহন ঘোড়ার গাড়ির ভিড়! বইয়ের ছবি ছাড়িয়ে সেই প্রথম ঘোড়ার গাড়ি দেখে ওঠা আমার! আর তবলার বোলের মতো সেই ভাষা—আহেন! আহেন! পঙ্খীরাজ লয়া খাড়ায়া আছি!’এ যেন স্বপ্নঝড়ের টানে বাইরে বেরিয়ে স্বপ্নভেজা হয়ে ঘরে ফেরার গল্প। তবে ঘরের দিকে যাওয়ার পথে কত বিচিত্র বাহির যে মূর্ত এখানে! পঞ্চাশের দশকের এই স্মৃতিবয়ানে পাঠক পাবেন কাসবা-গুলসিতান-মিরান্ডা-শাহবাগ হোটেল-রিভারভিউ ক্যাফে-গ্রীন হোটেল-খোশমহল -ইসলামিয়া রেস্টুরেন্ট কিংবা চু চিন চাও রেস্তোরাঁয় চা-কফির কাপে টুংটাং, কবিতার নতুন কুঁড়ি কি গল্প-উপন্যাসের খসড়া থেকে শুরু করে প্রথম প্রেমের ফাল্গুনী উদ্‌গমে ভরা এক ঝলমলে সরাইখানার দেখা। এই বইয়ে ঢাকার বিগত দিনের ছাপাখানা থেকে পুস্তকশালার যে আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে, তা স্মৃতিসুধা বিলানোর পাশাপাশি ইতিহাস রচনার উপাদানও সরবরাহ করবে আর লেখকের বর্ণনা হারানো খাদ্য থেকে বিলুপ্ত পাঠাগারের জন্য হাহাকার তৈরি করবে বর্তমানের বিধ্বস্ত নীলিমার নিচে বাস করা শহরবাসীর হৃদয়ে—পাটুয়াটুলীর গেটের কাছে ক্যানটিন চালান সামাদ নামে একজনা, আহ্, থাবায় আঁটে না পেল্লায় শিঙাড়া হতো, গরম গরম নামতো এগারোটার দিকে, কামড় দিলেই ধনেপাতা, আলু আর বাদাম মিশিয়ে সে যে একটা স্বাদ!—আহ্, এখনো আমি ওই স্বাদটির জন্যে ষোলো বছর বয়স ফিরে পেতে চাই।’ কিংবা—ভোজন জনশালা।

অনলাইন ডেস্ক
- Advertisement -

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত