নানা কর্মব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে কিছু মানুষ যেতে চায় বহুদূরে। মনের আকাশে ইচ্ছা ঘুড়িগুলো উড়ে বেড়ায়, মাঝে মাঝে মেঘ পাড়ি দিয়ে ছুঁতে চায় দিগন্ত। আনমনে গেয়ে ওঠে চলনা ঘুরে আসি অজানাতে…। শৈশব থেকেই আমি ভ্রমণ পিয়াসী। ছোটবেলায় প্রবাদে পড়েছি ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। তাই এই অভিলাসি মনের ইচ্ছা পূরণে ছুটে গতবছরের আগস্টে ছুটে গিয়েছিলাম পৃথিবীর রানী খ্যাত পাহাড়ের রাজ্য দার্জিলিং শহরে। যেটুকু ধারণা ছিলো তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ উপভোগের সুযোগ দার্জিলিং এ রয়েছে সেটা ঘুরে আসার পর বুঝলাম। দার্জিলিংয়ের প্রতিটি বাঁকে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লিলাভূমির এ দেশে কখন মেঘ আর কখন বৃষ্টি তা বোঝার অবকাশ কারো থাকেনা। পাহাড়ের চূড়া আর মেঘেদের দ্বিগি¦দিক ছোটাছুটির মুহুর্ত যে কতটা সৌন্দর্যের তা কল্পনা অতীত। যে দিকেই তাকায় মন ভেসে যায় সুখের খেয়ায়। নিজেকে কখনো কবি, কখনও বা নায়ক বনে যেতে ইচ্ছে হয়। শরীরে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছা করে এটা কি স্বপ্ন না সত্যি?
গত বছরের ৮ আগষ্ট দুপুরে বেনাপোলের ট্রেন ধরে যশোর থেকে রওনা দিলাম আমরা চারজন। আমি, বন্ধু হিমেল, হিমেলের স্ত্রী জুই ও ছোট ভাই শাওন। যশোরের আমি একা অন্য ওরা তিনজন ছিল খুলনার। সন্ধ্যার কিছু আগেই বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে পৌঁছালাম ভারতের বনগাঁ শহরে। দূর্গাপূজার শেষের দিন হওয়ায় রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। ততক্ষণে কোলকাতা যাবার শেষ বাসটি চলে গেছে। অর্থাৎ কলকাতা যাবার জন্য ট্রেনই একমাত্র ভরসা। কিন্তু ট্রেনেও প্রচন্ড ভিড়ের কারনে থেকে গেলাম স্টেশনের পাশেই একটি গেষ্ট হাউজে।
পরের দিন সকালের ট্রেন ধরে পৌঁছালাম কোলকাতা। সময় লাগলো ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট। কোলকাতা নিউমার্কেটের পাশেই একটি মুসলীম হোটেলে দুপুরের খাবার শেষে ধর্মতলা বাসস্টান্ডে যেয়ে চারটি টিকিট কাটলাম। সন্ধা ছয়টা ৩০ মিনিটে বাস ছাড়বে। কিছু সময় হাতে থাকায় আশপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকলাম। বাসটি
ছাড়লো ঠিক ৬ টা ৫০এ। স্লিপার কোচে শুয়ে শুয়ে কেটে গেল ১৯ ঘন্টা। মাঝপথে তিন জায়গায় যাত্রাবিরতি। রাস্তায় প্রচন্ড যানযটের কারনে পরের দিন ১০ আগস্ট দুপুর ১ টায় ৪৫ এ পৌছালাম শিলিগুড়ি শহরে। একঘন্টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষে চারজনে একটি জিপ গাড়িতে চড়ে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ঐ জীপ গুলো পাহাড়ে চলার উপযোগী।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং দিকে রওনা দেওয়ার ৩৫ মিনিট পর থেকেই পাহাড় গুলোর মাথা দেখা যাচ্ছিল। যেন পাহাড় গুলো আমাদের ডাকছে। পাহাড় গুলোর উপরেই দার্জিলিং। অনেক উপরে। নিচ থেকে যে পাহাড়টি দেখি, ঐ পাহাড়টির চুড়ায় উঠলে নতুন পাহাড়ের চুড়া দেখা যায়। তারপর ঐটার উপর ও উঠি, তারপর আরেকটা । এভাবেই উপরের দিকে উঠতে থাকি। পাহাড়ের মাঝে মাঝে বসতি। হঠাৎ বৃষ্টির আগমন। গাড়ি চালক বিরতি দিলেন। এ সুযোগে আমরা একটু দার্জিলিং চা খেয়ে নিলাম আর মেঘ, পাহাড় ও বৃষ্টির সাথে সেলফি তুললাম।
আবার যাত্রা শুরু। পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি উঠছে। আর মেঘ এসে গাড়িতে ধাক্কা দিচ্ছে। অনেক উপড়ে উঠার পর মেঘের জন্য আর নিচের তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না। কেমন যেন ঝাপসা দেখাচ্ছিল সব। মনে হচ্ছিল বিমানে উঠেছি। এরপরও গাড়ি উঠছে উপরের দিকে। পাহাড়ি রাস্তা গুলোর মোড় গুলো অদ্ভুত ভয়ঙ্কর। মাঝে মাঝে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন। পাশে তাকালেই পাহাড়ের পাদদেশ। কোন ভাবে পড়লে নিজেকেই শুধু নয় গাড়িটির ও খোজ পাওয়ার উপায় না থাকার মত অবস্থা। ২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট পর পৌছালাম স্বপ্নের দার্জিলিং শহরে।
দার্জিলিং এর মূল শহরে অনেক মানুষ জন। অনেক ভিড়। অনেক দোকান পাট। আমার ধারণা ছিল শান্ত একটা একটা শহর হবে। বাস্তবে এই পাহাড়ের উপরও ও জ্যাম লাগে। এসব দৃশ্য দেখে আমি কিছুটা আশাহত হলাম। । জীপ থেকে নামলাম দার্জিলিং জংশনের সামনে। চোখে পড়লো টই ট্রেন। পাহাড়ের উপরদিয়েও ট্রেনের চলাচল ভাবতে অবাক লাগলো। তবে এটুকু বুঝলাম এখানে সবচেয়ে কষ্টের কাজ থাকার হোটেল ঠিক করা। মালিক নয় দালালের হাতেই হোটেলের দামদর নির্ধারন করা রয়েছে। বাংলাদেশী জানতে পেরে আমাদের কাছেও হাকিয়ে দাম চেয়েছিল । অবশেষে দার্জিলিং জংশনের পাশের একটি হোটেলে অবস্থান করলাম। ওই দিন সন্ধায় দার্জিলিং স্টেশন সহ আশপাশের কয়েকটি মার্কেট ঘুরে সময় কাটালাম। এবার রাতের খাবারের পালা।
লোকমুখে জানতে পারি বড় মসজিদের পাশে কয়েকটি মুসলিম হোটেল আছে। কথাটা শুনে ভালোই লাগলো। পায়ে হেটে রওনা দিলাম। উচুনিচু ঢালু পাহারের রাস্তা যেন শেষই হচ্ছেনা। ৩০ মিনিট হাটার পর পৌছালাম খাবার হোটেলে। সেখানে রয়েছে গরুর মাংশ, গরুর কলিজা ও সাদা ভাত এছাড়া রয়েছে রুটির ব্যবস্থা। মাত্র ৪০ রুপি কলিজার প্লেট আর ২০ রুপিতে পেট চুক্তি সাদা ভাত খেয়ে সবার প্রাণ জুড়িয়ে গেল। খাওয়া শেষে আবার হাটা শুরু। খাবার হোটেল থেকে খেয়ে হেঁটে আবাসিক হোটেলে আসতে আসতে যেন হজম হয়ে গেল পেটের অর্ধেক খাবার ।
পরের দিন দার্জিলিং ঘোরার জন্য একই হোটেলে থাকা চারজন ইন্ডিয়ান টুরিস্টের সাথে যুক্ত হয়ে আমরা হলাম আটজন । আগে থেকেই আমরা জীপগাড়ি ঠিক করে রাখলাম। সবাই খুবই ক্লান্ত তাই বেশী রাত না জেগে ঘুমিয়ে পরলাম। দার্জিলিং ভ্রমন কারীদের জন্য টাইগার হিল একটা অন্যতম স্পট। সবাই যায় সূর্যোদয় দেখতে। আর তা দেখা জন্য বের হতে হয় ভোর চারটায়। টাইগার হিল দার্জিলিং এর সবচেয়ে উঁচু যায়গা। মূল টাউন থেকে প্রায় ১১ কিলো দূর। আর জীপে করে পৌছাতে প্রায় ৪০ মিনিটের মত লাগে। অনেক মানুষ যাচ্ছে ঐখানে। সারি সারি জিপ, একটার পেছনে আরেকটা। বাঘ পাহাড়ে উঠে সূর্র্যোদয় দেখার জন্য সবাই জড়ো হয়। একপর্যায় পূর্বদিকে আস্তে আস্তে উঠে সূর্যের লাল আভা । আস্তে আস্তে লাল আভার পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক সময় সূর্যমামা উঁকি দেয়। সাথে সাথে সবাই চিৎকার করে উঠে। আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে সবাই।
বাতাশিয়া লুপে না গেলে দার্জিলিং ভ্রমনটা আসলেই অতৃপ্ত থেকে যেত। বাতাসিয়া লুপের সামনে নেমে আমরা খেলাম স্থানীয় প্রিয় খাবার মোমো আর চিকেন লুডুস। বাতাসিয়া লুপে কিছু ফুল গাছ সুন্দর করে সাজানো আছে। রয়েছে ছোট রেল । সবচেয়ে যেটা সুন্দর, তা হচ্ছে বাতাসিয়া লুপ থেকে দার্জিলিং শহরের দৃশ্য। এখান থেকে দার্জিলিং এর অনেক
অংশের অসাধারণ ভিউ দেখা যায়। কেউ কেউ আবার এখান থেকে নেপালিয়ান পোষাক ভাড়া করে ছবি তুলছে। কেউ টেলিস্কোপ দিয়ে পাহাড় মেঘের খেলা দেখছে। সে যেন এক অপরুপ সৌন্দর্যের চিত্র। এরপর আমরা রক গার্ডেন যাবার জন্য রওনা হলাম। রক গার্ডেনের ভেতরে কী আছে বা দেখতে কেমন এটার থেকে বেশি টানছিল রক গার্ডেন যাওয়ার রাস্তা। দার্জিলিং শহর থেকে এটি অনেক নিচে। শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। যাওয়ার পথে অনেক গুলো চা বাগান চোখে পড়ল। আর নিচ থেকে দার্জিলিং শহর ও চোখে পড়ল। আবহাওয়াটা বেশ ভালো থাকায় সব কিছু অনেক দারুণ লাগতেছিল। জীপ পাহাড়ের গা বেয়ে যত উঁচু থেকে নিচুতে নামছে চা বাগান যেন আরও ঘন হয়ে দে
দেখতে পেলাম কিন্তু এ পাহাড় থেকে আরেক পাহারে যাবার ভাগ্য হলোনা। টিকিট কাটার জন্য নির্ধারিত সময় শেষ। পরে গেলাম হিমালয় মাউনটেন ট্রেনিং ইন্সটিউিট, হিমালয় মিউজিয়াম ও চিড়িয়াখানাতে। এই তিনটি স্পট পাশাপাশি। একই প্রবেশ ফিতে তিনটি স্পটই দেখা যায়। তবে এটি অনেক উচুতে। আমাদের সাথে থাকা ৫ জন এ পাহাড়ে উঠার বল পেলো না। আমি সহ আরো দুজন গেলাম। দেখলাম যারা হিমালয় পর্বতে উঠতে যেয়ে জীবন দিয়েছে তাদের সরঞ্জাম। হিমালয়ে উঠতে যারা এখনো প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে দেখা হলো। এছাড়াও পাহাড়ের বুকে নানা ধরনের পশু পাখির আড্ডা দেয়ার চিত্রটাও উপলব্ধি করলাম। ঘন্টা খানিক ঘুরে গাড়িতে চড়ে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। এসব স্পটের বাইরেও সময় সংক্ষেপের কারনে দার্জিলিং এর আরো অন্তত ৬/৭ টি অপরুপ স্পট গাড়িতে বসেই দেখেছি। কোনোটিই যেন কোনোটির থেকে সৌন্দর্যে কম নয়। এদিন রাতে চৌরাস্তা গিয়েছিলাম। এটা দার্জিলিং এর কেন্দ্র। চৌরাস্তার পরেই রয়েছে মল। এখানে অনেকটুকু সমতল জায়গা। অনেক মানুষ জড়ো হয়। চারপাশ সুন্দর ভাবে দেখা যায়। আর এখানে রয়েছে একটা স্টেজ। কনসার্ট বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হয় এখানে। এখান থেকে স্থানীয় কিছু প্রিয় খাবার খেলাম, কিছু কেনা কাটা করলাম । রাতে আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরলাম। পরেরদিন দুপুরে জিপে করে রওনা দিলাম ফেরার উদ্দেশ্যে। এবার শুধু পাহাড় থেকে নামার পালা। নামছি আর উপভোগ করছি অপরুপ মুহুর্ত। সূর্য মেঘের আড়াল হলেই কেমন সব অন্ধকার বা মেঘলা লাগছে। আরো বেশি ঠান্ডা লাগছে। হঠাৎ আবার বৃষ্টি। ভেজা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি নামছে আর সেসময় আমাদের গা শিউরে উঠছে।
এবার ফেরার পালা। সন্ধায় পৌছালাম শিলিগুড়ি। কোলকাতা ফেরার ট্রেনের কিংবা বাসের কোনোটারই সিট খালি নেই। এক দালালের মাধ্যমে বাড়তি টাকা দিয়ে স্লিপার কোচের টিকিট কিনে সাড়ে সাতটায় রওনা দিলাম। পরের দিন দুপুরে পৌছালাম কোলকাতায়। এদিন কিছু কেনাকাটা করলাম। রাতটি আবাসিক একটি হোটেলে থেকে পরের দিন ট্রেনে করে প্রথমে বনগাঁ পরে বর্ডার পার হয়ে বেনাপোল থেকে একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে যশোরে পৌঁছালাম। এরই সাথে পূরণ হলো আমার অভিলাসি মনের আরো একটি ইচ্ছে ।
লেখক
শিমুল ভূইয়া
সাংবাদিক, দৈনিক গ্রামের কাগজ
দপ্তর সম্পাদক, যশোর জেলা সাংবাদিক ইউনিয়ন
উপদেষ্টা, রাতদিন নিউজ ডটনেট