যশোর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের আওতাধীন ভেকুটিয়া ক্লাস্টারের সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার-এটিইও হারুন অর রশিদের অনিয়ম দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন অধিকাংশ শিক্ষক। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকরা তার খাই মেটাতে রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছেন। তার আচরণে নাখোশ ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, সহকারী শিক্ষক ও অভিভাবকরাও। ইতিমধ্যে ভেকুটিয়া ক্লাস্টার থেকে তাকে সরিয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে। সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হারুন অর রশিদ ভেকুটিয়া ক্লাস্টারের দায়িত্বে রয়েছেন। এই ক্লাস্টারে তার দু’বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তিনি টাকা ছাড়া কোনো বিল কিংবা প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করেননি বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। এসিআর দিতে ঘুরিয়েছেন দিনের পর দিন। এমন কোনো খাত নেই যে, সেই খাত থেকে এটিইও টাকা নেননি। একাধিক প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ,এটিইও হারুন কেবল বিভিন্ন বিলের বিপরীতে উপরি নেননি। তিনি নানা ধরনের বরাদ্দ এনে দেয়ার নাম করেও অর্থ হাতিয়েছেন।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এটিইও হারুন অর রশিদ ডুমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদ্র মেরামতের বরাদ্দ থেকে সম্মানি নিয়েছেন ১৫ হাজার টাকা! তবে, আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এই সম্মানির পরিমাণ ১০ হাজার টাকা। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন তাকে টাকা দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। কেবল তাই না, এই বরাদ্দ থেকে সদ্য সাবেক সভাপতি আবুল কালাম কাজল ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এই স্কুলে ক্ষুদ্র মেরামতের জন্য দু’লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। সেই বরাদ্দ থেকে নামমাত্র কাজ হয়েছে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, সভাপতি, এটিইও এবং প্রধান শিক্ষক যোগসাজস করে নামমাত্র কাজ করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্লিপ, ওয়াশব্লক, প্রাকপ্রাথমিক, রুটিন মেইনটেইনেন্স, ছোটোখাটো মেরামত, খেলাধুলা এবং বিভিন্ন দিবস উদযাপনের জন্য বরাদ্দ আসে। এসব বরাদ্দের বিল নেয়ার সময় এটিইও’র প্রত্যয়ন লাগে। হারুন অর রশিদ এই প্রত্যয়ন দেয়ার সময় শিক্ষকদের নানাভাবে ঘোরাতে থাকেন। একপর্যায়ে অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। শেষ অবধি শিক্ষকরা তাকে নগদ নারায়ণে তুষ্ট করে বিল ছাড় করান। তার অনিয়ম এখানেই শেষ না। তিনি রীতিমতো জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার-ডিপিইও এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার-টিইওকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অর্থের বিনিময়ে সহকারী শিক্ষকদের ডেপুটেশন দিয়েছেন। এ ধরনের দু’জনের তথ্য এসেছে গ্রামের কাগজের কাছে। এদের একজনকে আরিচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হালসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আরেকজনকে চান্দুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আরিচপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশন দিয়েছেন এটিইও হারুন অর রশিদ। এর বাইরে আরও কয়েকজন সহকারী শিক্ষককে নিজে মাতব্বরি করে ডেপুটেশন দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। যা তিনি কোনোভাবেই করতে পারেন না।
ডেপুটেশন দেয়ার বিধি হচ্ছে, যেসব স্কুলে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক কম সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রথমে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর লিখিতভাবে আবেদন করবেন। এরপর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সেটি যাচাই করে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠাবেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার পর একজন সহকারী শিক্ষক ডেপুটেশনে যেতে পারবেন। ক্লাস্টার অফিসার হারুন অর রশিদ এই প্রক্রিয়ার কোনোটিই না করে নিজে নিজে অর্থের বিনিময়ে ডেপুটেশন দিয়েছেন। যা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, তিনি হালসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ নারাঙ্গালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডুমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এফএমবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চান্দুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মন্ডলগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন এবং অর্থ নিয়েছেন। ভেকুটিয়া ক্লাস্টারের ২৭ টি স্কুলের মধ্যে হাতেগোনা দুয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ স্কুল থেকে নানা উপায়ে অর্থ হাতিয়েছেন বলে শিক্ষকদের অভিযোগ। এটিইও হারুনের কাজে চারজন প্রধান শিক্ষক সহযোগিতা করেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। ওই চারজন প্রধান শিক্ষক তাদের স্কুলে তেমন কোনো কাজ না করেও এটিইও’র বদান্যতায় পার পেয়ে যান। হয়রানির শিকার শিক্ষকরা এখনই ভেকুটিয়া ক্লাস্টার থেকে এটিইও হারুনকে বদলি করার দাবি জানিয়েছেন। এরপর তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাদের।
এ ব্যাপারে এটিইও হারুন অর রশিদ বলেন,‘আমি কাজের বিষয়ে কড়াকড়ি করার কারণে কোনো কোনো শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। আমি দু’একজনকে মৌখিকভাবে কয়েকদিনের জন্য ডেপুটেশন দিয়েছিলাম ঠিক। পরে তারা নিজ নিজ স্কুলে ফিরে গেছে।’ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে বুধবার সকালে জানতে চাইলে তিনি এটিইও হারুনের সাথে কথা বলে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর কথা বলেননি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আশরাফুল আলম বলেন, ওই এলাকার মানুষ তার কাছে অভিযোগ করেন। এরপর তিনি এটিইও হারুনকে ডেকে অন্য ক্লাস্টারে বদলি হতে বলেন। হারুন ডিপিইও বরাবর বদলির আবেদন দিয়েছেন। ডেপুটেশনের বিষয়ে ডিপিইও বলেন,‘ডেপুটেশন দেয়ার বিধি হচ্ছে, টিইও বরাবর আবেদন আসার পর তিনি যাচাই করে সুপারিশ করে ডিপিইও’র কাছে পাঠাবেন। ডিপিইও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার পর কোনো শিক্ষক ডেপুটেশনে যেতে পারবেন। এর আগে কোনোভাবেই ডেপুটেশন হবে না।
এদিকে, সদর উপজেলা পর্যায়ে এ বছর জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ এটিইও হয়েছেন এই দুর্নীতিবাজ হারুন অর রশিদ। উপজেলায় ১০ এটিইও’র মধ্যে তিনি এটি বাগিয়ে নিয়েছেন। একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কীভাবে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, যতসব বিতর্কিত আর দুর্নীতিবাজরা এ ধরনের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ হওয়ায় যোগ্যরা সামনে আসতে চান না। এই জায়গা থেকে শিক্ষা বিভাগকে বের হতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অনলাইন ডেস্ক ।