বনী ইসরাঈলের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাওরাত কিতাব নাজিল করেছিলেন। মুসা আ.-এর ইন্তেকালের পর তারা সময়ে সময়ে এতে বিকৃতি সাধন করেছিল। মুসা আ.-এর জীবদ্দশায় এবং পরবর্তী সময়েও আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তাদের এই অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কয়েক দফায় শাস্তি দিয়েছিলেন। কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় এসব বর্ণিত হয়েছে।
সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুর দিকের কয়েকটি আয়াতে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
বনী ইসরাঈল প্রথমবার আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হলে আল্লাহ তায়ালা শত্রুদেরকে তাদের উপর চাপিয়ে দেন। শত্রু তাদেরকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। এরপর তারা কিছুটা হুঁশিয়ার হলে এবং অনাচারের অভ্যাস কিছুটা কমে আসলে তাদের অবস্থার উন্নতি হয় ।
কিন্তু কিছু দিন পর আবার তাদের মধ্যে অনাচার ও কুকর্ম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে আল্লাহ তায়ালা পুনরায় শত্রুদের হাতে লাঞ্ছিত করেন। কোরআন পাকে দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ইতিহাসে এ ধরনের ছয়টি ঘটনা বিবৃত হয়েছে।
বনী ইসরাঈলের ওপর প্রথমবার শত্রুর আক্রমণ
বর্তমান মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠাতা হজরত সোলায়মান আ.-এর ওফাতের কিছু দিন পরে প্রথম ঘটনাটি সংঘটিত হয়। বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসনকর্তা ধর্মদ্রোহিতা ও কুকর্মের পথ অবলম্বন করলে মিসরের জনৈক সম্রাট তার উপর চড়াও হয় এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের স্বর্ণ ও রৌপ্যের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যায়, কিন্তু নগরী ও মসজিদকে বিধ্বস্ত করেনি।
বনী ইসরাঈলের ওপর দ্বিতীয়বার শত্রুর আক্রমণ
এর প্রায় চারশ বছর পর সংঘটিত হয় দ্বিতীয় ঘটনাটি। বায়তুল মোকাদ্দাসে বসবাসকারী কিছু ইহুদী মূর্তি পূজা শুরু করে। অন্যরা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হয়। পরিণামে পুনরায় মিসরের জনৈক সম্রাট তাদের উপর আক্রমণ চালায় এবং নগরী ও মসজিদ প্রাচীরেরও কিছুটা ক্ষতিসাধন করে। এই হামলার পর বনী ইসরাঈলের হুঁশ ফিরে তারা আল্লাহর বিধান মানার প্রতি কিছুটা মনোযোগী হয়।
বনী ইসরাঈলের ওপর তৃতীয়বার শত্রুর আক্রমণ
এর কয়েক বছর পর তৃতীয় ঘটনাটি সংঘটিত হয়, যখন বাবেল সম্রাট বুখতা নছর বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমণ করে এবং শহরটি পদানত করে প্রচুর ধনসম্পদ লুট করে নেয়। সে অনেক লোককে বন্দী করে সঙ্গে নিয়ে যায় এবং সাবেক সম্রাট পরিবারের জনৈক ব্যক্তিকে নিজের প্রতিনিধিরূপে নগরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে।
বনী ইসরাঈলের ওপর চতুর্থবার শত্রুর আক্রমণ
বুখতা নছর বনী বায়তুল মুকাদ্দাস হামলা করে যাকে নগরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিল সে ছিল মূর্তিপূজক ও অনাচারী। সে বুখতা নছরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
তার বিদ্রোহ ঘোষণার পর বুখতা নছর আবারো বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমণ করে। এবার সে ব্যাপক হত্যা ও লুটতরাজ চালায়। আগুন লাগিয়ে পুরো শহরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে করে।
এ দুর্ঘটনাটি সোলায়মান আ.-এর মসজিদ নির্মাণের প্রায় ৪১৫ বছর পর সংঘটিত হয়। এরপর ইহুদীরা এখান থেকে নির্বাসিত হয়ে বাবেলে স্থানান্তরিত হয়।
সেখানে চরম অপমান, লাঞ্ছনা ও দুর্গতির মাঝে ৭০ বছর অতিবাহিত হয়। এরপর ইরান সম্রাট বাবেলেও আক্রমণ করে বাবেল দখল করে নেয়। ইরান সম্রাট নির্বাসিত ইহুদীদের প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়ে তাদেরকে আবারো সিরিয়ায় পৌঁছে দেয় এবং তাদের লুণ্ঠিত দ্রব্য-সামগ্রীও তাদের হাতে প্রত্যর্পণ করে।
এ সময় ইহুদীরা নিজেদের কুকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে এবং নতুনভাবে বসতি স্থাপন করে ইরান সম্রাটের সহযোগিতায় পূর্বের নমুনা অনুযায়ী মসজিদে আকসা পুনর্নির্মাণ করে।
বনী ইসরাঈলের ওপর পঞ্চমবার শত্রুর আক্রমণ
ইহুদীরা এখানে আগের মতো সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করে অতীতকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। তারা আবার পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এরপর হজরত ঈসা আ.-এর জন্মের ১৭০ বছর পূর্বে আরেকটি হামলার সংঘটিত হয়।
আন্তাকিয়া শহরের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট ইহুদীদের উপর আক্রমণ করে। সে ৪০হাজার ইহুদীকে হত্যা এবং ৪০ হাজারকে বন্দী ও গোলাম বানিয়ে সঙ্গে নিয়ে যায়। সে মসজিদেরও অবমাননা করে, কিন্তু মসজিদের মূল ভবনটি রক্ষা পেয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে এ সম্রাটের উত্তরাধিকারীরা শহর ও মসজিদকে সম্পূর্ণ ময়দানে পরিণত করে। এর কিছু দিন পর বায়তুল মোকাদ্দাস রোম সম্রাটদের দখলে চলে যায়। তারা মসজিদের সংস্কার সাধন করে এবং এর আট বছর পর হযরত ঈসা আ. দুনিয়াতে আগমন করেন।
বনী ইসরাঈলের ওপর ষষ্ঠবার শত্রুর আক্রমণ
হজরত ঈসা আ.-এর সশরীরে আকাশে উত্থিত হওয়ার ৪০ বছর পর ষষ্ঠ ঘটনাটি ঘটে। ইহুদীরা রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ফলে রোমকরা শহর ও মসজিদ পুনরায় বিধ্বস্ত করে আগের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয়।
তখনকার সম্রাটের নাম ছিল তাইতিস। সে ইহুদীও ছিল না খ্রিস্টানও ছিল না। তার অনেক দিন পর কনস্টানটাইন প্রথম খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এরপর থেকে খলীফা হযরত ওমর রা.-এর সময় পর্যন্ত মসজিদটি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। হজরত ওমর রা. মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করান।
এ ছয়টি ঘটনা তফসীরে হক্বানীর বরাত দিয়ে তফসীরে বয়ানুল কোরআনে ও তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে লিখিত হয়েছে।
সূরা বনী ইসরাঈলে এদিকে ঈঙ্গিত করে বর্ণিত হয়েছে,
وَاٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ وَجَعَلۡنٰہُ ہُدًی لِّبَـنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اَلَّا تَتَّخِذُوۡا مِنۡ دُوۡنِیۡ وَکِیۡلًا ؕ ٢ ذُرِّیَّۃَ مَنۡ حَمَلۡنَا مَعَ نُوۡحٍ ؕ اِنَّہٗ کَانَ عَبۡدًا شَکُوۡرًا ٣ وَقَضَیۡنَاۤ اِلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ فِی الۡکِتٰبِ لَتُفۡسِدُنَّ فِی الۡاَرۡضِ مَرَّتَیۡنِ وَلَتَعۡلُنَّ عُلُوًّا کَبِیۡرًا ٤ فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ اُوۡلٰىہُمَا بَعَثۡنَا عَلَیۡکُمۡ عِبَادًا لَّنَاۤ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ فَجَاسُوۡا خِلٰلَ الدِّیَارِ ؕ وَکَانَ وَعۡدًا مَّفۡعُوۡلًا ٥ ثُمَّ رَدَدۡنَا لَکُمُ الۡکَرَّۃَ عَلَیۡہِمۡ وَاَمۡدَدۡنٰکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّبَنِیۡنَ وَجَعَلۡنٰکُمۡ اَکۡثَرَ نَفِیۡرًا اِنۡ اَحۡسَنۡتُمۡ اَحۡسَنۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ ۟ وَاِنۡ اَسَاۡتُمۡ فَلَہَا ؕ فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ الۡاٰخِرَۃِ لِیَسُوۡٓءٗا وُجُوۡہَکُمۡ وَلِیَدۡخُلُوا الۡمَسۡجِدَ کَمَا دَخَلُوۡہُ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّلِیُتَبِّرُوۡا مَا عَلَوۡا تَتۡبِیۡرًا
এবং আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম এবং তাকে বনী ইসরাঈলের জন্য হিদায়াতের মাধ্যম বানিয়েছিলাম। আদেশ করেছিলাম, তোমরা আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে কর্মবিধায়করূপে গ্রহণ করো না।
হে ওই সকল লোকের বংশধরগণ! যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম। সে ছিল খুবই শোকরগোজার বান্দা।
আমি কিতাবে মীমাংসা দান করে বনী ইসরাঈলকে অবহিত করেছিলাম, তোমরা পৃথিবীতে দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং ঘোর অহংকার প্রদর্শন করবে।
সুতরাং যখন সেই ঘটনা দু’টির প্রথমটি সমুপস্থিত হল, তখন আমি তোমাদের উপর আমার এমন বান্দাদেরকে আধিপত্য দান করলাম, যারা ছিল প্রচণ্ড লড়াকু। তারা তোমাদের নগরে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ল। এটা ছিল এমন এক প্রতিশ্রুতি, যা কার্যকর হওয়ারই ছিল।
তারপর আমি তোমাদেরকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের উপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দিলাম এবং তোমাদের ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততিতে বৃদ্ধি সাধন করলাম। আর তোমাদের লোকসংখ্যা আগের তুলনায় বৃদ্ধি করলাম।
তোমরা সৎকর্ম করলে তা নিজেদেরই কল্যাণার্থে করবে আর যদি মন্দ কাজ কর, তাতেও নিজেদেরই অকল্যাণ হবে। অতঃপর যখন দ্বিতীয় ঘটনার নির্ধারিত কাল আসল, (তখন আমি তোমাদের উপর অপর শত্রু চাপিয়ে দিলাম,) যাতে তারা তোমাদের চেহারা বিকৃত করে দেয় এবং যাতে আগের বার তারা যেভাবে প্রবেশ করেছিল, এবারও সেভাবে মসজিদে প্রবেশ করে এবং যা-কিছুর উপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় তা মিসমার করে দেয়। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত : ২-৭)
অনলাইন ডেস্ক