যশোরের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকার অন্যতম কিলার শামীম দুটি অস্ত্র মামলায় (৭ ও ১৭ বছর) সাজাপ্রাপ্ত।
হত্যা, ধর্ষণ, অপহরন, গুম, চাঁদাবাজিসহ সকল কুৎসিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের নায়ক কিলার শামীমের বিরুদ্ধে যশোর ও চৌগাছা থানায় ৫টি হত্যাসহ মাত্র ১৪টি মামলার হদিস পাওয়া যায়।
তবে গ্রামবাসীসহ তার বন্ধু জানিয়েছে কিলার শামীম বাংলাদেশের যশোর শহর, সাতমাইল, বারোবাজার, ঝিনাইদহসহ ভারতের বঁনগা থানার অর্ন্তগত বয়রা ও গাঢ়াপোতাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এবং কলকাতাতেও বিভিন্ন হত্যাকান্ডের নায়ক। শামীম কবির ওরফে কিলার শামীম যশোরের চৌগাছা উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের মৃত সামছুল হকের ছেলে। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাশের পরে জামালতা গ্রামের আমির নামে বিএনপির এক কর্মীকে গাছি দা দিয়ে কোপ দেয় শামীম। পরে তার বাবা তাকে ১৯৯৫ সালে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেন এবং ৪/৫ মাস পরে দেশে ফিরে আসে সে। সন্ত্রাসী হিসেবে শামীম ১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। এরপর ১৯৯৭ সালে জেলখানায় যশোর সাতমাইল শ্যামনগরের মোখলেছুর রহমান নান্নু ওরফে কিলার নান্নুর সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯৯৬’র আওয়ামী লীগের সময় যশোর জেলা, বারোবাজার, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহসহ দক্ষিনাঞ্চলে সর্বহারা পাটির শরিফুল বাহিনী বেশ প্রভাব বিস্তার করে। ঐ বাহিনীর হয়ে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যার কারনে নান্নু ওরফে মোখলেছুর রহমান নান্নুকে শরিফুল তার বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ঘোষনা করে। ১৯৯৭ সাল থেকে চৌগাছার কিলার শামীমের গ্রাম নান্নুর নিরাপদ আশ্রয় ছিল। চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক বর্তমান সভাপতি এসএম হাবিবুর রহমানের সর্বোচ্চ আস্থাভাজন হওয়ায় সেসময় পুলিশ ওই গ্রামের আসেপাশে ভিড়তো না। শামীম তার বন্ধু জাহাঙ্গীরপুরের নান্নু ও কিলার নান্নু ১৯৯৮ সালের ১৬ জুন পুলিশের হাতে চাকুসহ গ্রেফতার হয়। সেই মামলায় শামীমের তার ৭ বছর সাজা হয়। ১৯৯৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১/১২টার দিকে কিলার শামীম, নান্নুসহ সন্ত্রাসীরা মকবুল হোসেন নামে বিএনপির এক ইউপি সদস্যকে গুলি করে ও কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে হত্যা করে। পরবর্তীতে মামলার আইওকে ম্যানেজ করে মামলার চার্জশীট থেকে নিজের নাম বাদ দেয়। একই বছর ১১ এপ্রিল গভীর রাতে বেড়গোবিন্দপুরের বাওড় গার্ড সহিদুল ইসলামকে নৃশংসভাবে চাকু মেরে ও কুপিয়ে হত্যা করে কিলার শামীম ও বাহিনী। ২০০৪ সালে গরীবপুর গ্রামের বিএনপি কর্মী মান্নানকে ফুসলিয়ে ভারতে নিয়ে খুন করে কিলার শামীম। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী কিলার শামীম দল ক্ষমতায় না থাকলে ভারতে চলে যায়। সূত্র বলছে কিলার শামীম ভারতের বৈধ নাগরিক। ২০০১ সালে জোট সরকারের আমলে শামীম ভারতের বনগাও এর গাড়াপোতার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলয়-সাত্তারের শেল্টারে ছিল। সেখানেই ২০০৩’র ঈদের দিন সকাল ১০টার দিকে নিমাই নামে একজনকে খুন করে কিলার শামীমসহ অন্যান্যরা। ২০০৪-৫ সালে বনগাও কালপুরে একটি ও একই সালে হেলাঞ্চা বাজারে কংগ্রেসের স্থানীয় একজন নেতাকে শামীমের নেতৃত্বে খুন করা হয়। সেঘটনায় খুনিরা একটি মটর সাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশি তদন্তে সেটি সন্ত্রাসী সাত্তারের ছেলে আক্তারের মটরসাইকেল (পালসার) বলে জানা যায়। এবং খুনিদের পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। ২০০৫ সালে নদিয়া জেলার গোপালনগর থানায় কুতুবকে খুন করে শামীম ও তার বাহিনী। ২০০৬ সালে শামীম গাড়াপোতার ক্লাস লাইনের মুসলিম শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কাকে অপহরন করে। সে ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ জনতা মানব বন্ধন ও মিছিল করলে শামীমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০৬ সালে হানেফ এবং ২০০৯ সালে মিরপুরের সাহাদত বাহিনীর মুক্তারের নেতৃত্ত্বে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালির লাল বাহিনীর লাল ওরফে অবায়দুর রহমানকে ভারতে খুন করে শামীম ওরফে কিলার শামীম। এদিকে আবারো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ২০০৯ সালে দেশে ফিরে আসে শামীম। দেশে ফিরেই তার নিজ গ্রামের এক মেয়েকে তার বাপ মায়ের সামনে ধর্ষন করতে উদ্যত হলে মেয়েটি তার বালিশের নিচে রাখা দা দিয়ে শামীমের মুখের বাম পাশে কোপ দেয়। সে ঘটনায় শামীম দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিল। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ৭ বছরের শিশু সৌরভ সাহাকে অপহরন করে খুন করে কিলার শামীম। এর পরে ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি এসএম হাবিবের নির্দেশে সিংহঝুলি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভপতি জিল্লুর রহমান মিন্টুকে দুপুর আড়াইটার দিকে শত লোকের সামনে শর্টগান দিয়ে গুলি করে খুন করে কিলার শামীম। জিল্লুর রহমান মিন্টু চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক প্রার্থী হওয়ায় তাকে খুন করা হয়। এর আগে একই অপরাধে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও পাশাপোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুলকে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর গুলি করে ও বোম মেরে খুন করা হয়। সেঘটনায়ও এসএম হাবিবরে নাম আসেলেও বাদী তার নামে মামলা করতে সাহস করেনি। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর পুলিশ পরিচয়ে এক কলেজ ছাত্রের বাড়ির দরজা ভেঙ্গে শর্টগান ঠেকিয়ে উঠিয়ে নিয়ে ব্যাপক মারপিট করে কিলার শামীম ও তার বাহিনী। ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুযারি হাতে শর্টগান ও মাজায় পিস্তল গুজে রাখা একটি ছবিসহ কিলার শামীমের দেহরক্ষী জাহাঙ্গীরপুরের সন্ত্রাসী মনিকে নিয়ে ভোরের কাগজে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে কিলার শামীমের হাত থেকে নিজ স্ত্রী কন্যার ইজ্জত বাচাতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় কাঠ মিস্ত্রি আকতারুল। সে সময় আকতারুল জানিয়েছিল তার কথায় রাজি না হওয়ায় সেই শর্টগান দিয়ে তার বাড়ির ভিতর গিয়ে আকাশে গুলি ছুড়ে ভয় দেখিয়েছিল শামীম। এছাড়া গ্রামের হিন্দু পাড়ায় গৃহবধূদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতো এই কিলার শামীম। তবে বেশিরভাগ ঘটনায় থানার ওসিরা তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে দ্বিধাবোধ করতেন এবং কেউ কেউ নিতেন না। ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ফাকা গুলি ছুড়ে প্রাননাশের হুমকি দেয় কিলার শামীম। একই বছর ২৪ নভেম্বর রাতে মাতাল অবস্থায় নিজ গ্রামের আব্দুল নামে একজনকে শর্টগানের দিয়ে পিটাচ্ছিল কিলার শামীম। সেসময় আব্দুলের চিৎকারে তার ভাইসহ স্থানীয়রা এসে কিলার শামীমকে পিটিয়ে সেই শর্টগান কেড়ে নেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির খোসা ও একটি মটর সাইকেল উদ্ধার করে। কিন্তু কি এক আশ্চর্য কারনে কিলার শামীমের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। তবে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ও উদ্ধারকৃত আলামতের সেই ভিডিও এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্যমান। দীর্ঘদিন এই কিলার শামীম একের পর এক হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন ঘটনায় একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলেও আজ পর্যন্ত কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। তবে ১৯৯৯ সালে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পনের সময় কিলার শামীম একটি বন্দুক ও একটি ওয়ান শুটার গান জমা দিয়েছিল। দীর্ঘদিন নিজ গ্রামে থেকে গত ৫ আগষ্ট থেকে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা জানিয়েছেন শামীমের খালাত ভাই মনিরুল ইসলাম ঝিকরগাছা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা। সে তার ভায়ের আশ্রয়ে থাকে এবং গ্রামে আসা যাওয়া করে। চৌগাছায় অপকর্ম করেই আবার ঝিকরগাছায় চলে যায়। সেখানে হক সাহেব নামে এক যুবলীগ কর্মী সর্বদা কিলার শামীমের সহযোগি বলে জানা যায়। ৫ আগষ্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর কিলার শামীম ঝিকরগাছাতে অবস্থান করছিল বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এই সন্ত্রাসীর বিষয়ে জানতে চাইলে চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, সে এলাকায় নেই। তবে তারাও খোজ খবর নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
আর কে-০৭
- Advertisement -